ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একগুচ্ছ ছোটবড় দ্বীপের সমাহার মালয় দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ইন্দোনেশিয়ার বালি ও লম্বকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে এক প্রাচীন অদৃশ্য সীমারেখা– ওয়ালাস লাইন (Wallace Line)। ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালাসের নামে এর নামকরণ হয় ১৮৫৯ সালে।
ওয়ালাস লাইনের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য এর জীববৈচিত্র্য। এই অদৃশ্য লাইনের (The Invisible Barrier) পশ্চিমে ঘন জঙ্গলে দেখা যায় হাতি, বাঘ, গন্ডার প্রভৃতি। কিন্তু পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ পাল্টে যায় প্রাণীজগতের চরিত্র (2 Worlds Apart)। দেখা যায় কোয়ালা, কোমাডো ড্রাগন, হানিইটার ইত্যাদি প্রাণীর বাস। প্রকৃতির এই অদ্ভূত খেলার কারণেই ওই অদৃশ্য রেখাটিকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন জৈবভৌগোলিক সীমানা (Biogeographic boundary) হিসেবে।
কীভাবে তৈরি হল জৈবভৌগোলিক সীমানার ধারণা? ইতিহাস বলছে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) তত্ত্বের সহ প্রবক্তা অ্যালফ্রেড ওয়ালাস আট দিনের মালয় সফরে এই এলাকায় বালি ও লম্বকের মধ্যে সামান্য ব্যবধানে দু-ধরনের জীববৈচিত্র্য দেখতে পান। তিনি এই গোটা সফরে বহু প্রজাতির প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেন।
ওয়ালাসের মৃত্যুর প্রায় দেড়শো বছরের বেশি সময় পরে ভূবিজ্ঞানীরা অনুমান করেন পৃথিবীর জন্মলগ্নে প্লেট টেকটনিক তত্ত্বের কারণেই এই দুটি এলাকায় এত সামান্য দূরত্বে জীববৈচিত্র্যের এত বিপুল পার্থক্য ঘটেছে। এই প্লেট টেকটনিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই বিভিন্ন মহাদেশের জন্ম, পাহাড় পর্বত সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
গবেষণা বলছে, প্লেট টেকটনিকের ফলে পৃথিবীতে সৃষ্ট সবচেয়ে জটিল অঞ্চলগুলির একটি হল মালয় দ্বীপপুঞ্জ । সেই কারণেই এই অঞ্চলে এমন অদ্ভূত জীববৈচিত্র্য। ১৯৮০-র দশকে বিজ্ঞানীদের বদ্ধমূল ধারণা হয় ওয়ালাস লাইনের উদ্ভব প্লেট টেকটনকেরই কারণে, জীবদ্দশায় যার সন্ধান দিতে পারেননি স্বয়ং ওয়ালাস। তবে ওয়ালাস লাইনের (Wallace Line) দুদিকের এলাকা সুদূর অতীতে একটাই অবিভক্ত অঞ্চল (landmass) ছিল সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন।
এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া – দুটি মহাদেশের বন্যপ্রাণী ওয়ালাস লাইনের যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্বদিকে দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে জোরালো ও শক্তিশালী সমুদ্রস্রোতের ফলে বন্যপ্রাণীরা ওয়ালাস লাইন অতিক্রম করে পশ্চিম থেকে পূর্বে বা পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসা যাওয়া করতে পারে না।
ওয়ালাসের অদৃশ্য সীমারেখা (The Invisible Barrier) বাস্তব হতে পারে আবার কাল্পনিকও হতে পারে। কিন্তু আদিম পৃথিবীর নানা ভূতাত্ত্বিক ঘটনা কীভাবে আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে, কীভাবে জীববৈচিত্র্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি করে দেয়, ওয়ালাস লাইন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
https://www.thewall.in
No comments:
Post a Comment