Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Wednesday, 9 August 2023

মেদিনীপুরের গোপগড় ইকোপার্ক (Gopegarh Heritage & Nature Eco-tourism Centre)

ইরেজি শব্দ ইকোলজিক্যাল পার্ক (Ecological Park) অর্থাৎ বাস্তুসংস্থানগত উদ্যানের সংক্ষিপ্ত রূপ হল ইকোপার্ক (Eco Park)। ইকোপার্ক হল ইন-সিটু সংরক্ষণ ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশযুক্ত স্থান, যেখানে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়। ইকোপার্ক সাধারণ মানুষকে প্রকৃতিকেন্দ্রিক বিনোদন প্রদান করে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের পথ প্রশস্ত করে। তাই, প্রাকৃতিক পর্যটনে ইকোপার্ক গুরত্বপূর্ণ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপগড় ইকোপার্ক তেমনই একটি ইকোপার্ক, যা মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ৪.৫-৫ কিমি দূরে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। কঙ্কাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গোপগড় ইকোপার্কের আয়তন প্রায় ৪ বর্গকিমি (৪০ হেক্টর)। পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের উদ্যোগে ২০০০ সালের ২০ শে ডিসেম্বর গোপগড় ইকোপার্কের উদ্বোধন হয়। পরবর্তীতে, ২০০৬ সালের ১৫ ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন গোপগড় ও গোপ প্যালেসকে 'হেরিটেজ সাইট' হিসেবে ঘোষণা করে এবং নামকরণ করা হয় 'গোপগড় হেরিটেজ ও নেচার ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার' (Gopegarh Heritage & Nature Eco-tourism Centre)। 



গোপগড়কে নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক কাহিনী ও কিংবদন্তী রয়েছে। গোপগড় একটি ঐতিহাসিক স্থান, যার সাক্ষী হল গোপগড় হেরিটেজ হাউস সহ বিভিন্ন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। অনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম শতকে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের যুগে গোপগড় নির্মিত হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, মহাভারতের মৎস্য রাজ্যের অধিপতি বিরাট রাজার গোশালার অংশবিশেষ 'দক্ষিণ গোপগৃহ' হল আজকের গোপগড়। ধারণা করা হয়, গোপদের বিশ্রামগার 'গোপগৃহ' থেকেই 'গোপগড়' নামটি এসেছে। উল্লেখ্য, মহাভারতের কাহিনী অনুসারে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা মৎস্য রাজ্যে বিরাট রাজার আশ্রয়ে ছিলেন। যদিও, বিরাটনগর সহ মৎস্য রাজ্য বর্তমানে রাজস্থানে অবস্থিত। হয়তো অতীতে মহাভারতের কাহিনীর সাথে জড়িয়ে গোপগড়কে মহিমান্বিত করা হয়েছে। তবে অতীতে মেদিনীপুর এলাকা কোটদেশ (বর্তমানে ওড়িশার গড়জাত অঞ্চল) -এর অন্তর্গত ছিল এবং কোটদেশ অধিপতি বিরাট রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ কালেক্টর এল. এস. এস. ও'ম্যালি 'Bengal Districts Gazetteers Midnapore' (১৯১১)-তে উল্লেখ করেছেন যে, আইন-ই-আকবরীতে মেদিনীপুরকে জলেশ্বর সরকারের একটি বড়ো নগর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে ; যেখানে দুটি দুর্গ রয়েছে, একটি প্রাচীন ও অন্যটি নতুন। ওই প্রাচীন দুর্গটিই সম্ভবত গোপগড়। তবে, মেদিনীপুরের ইতিহাস গবেষক চিন্ময় দাশের মতে, জনশ্রুতি, প্রায় পাঁচশো-ছ’শো বছর আগে ওড়িশার রায়বনিয়া গড়ের রাজা বিরাটগুহ মেদিনীপুরে উঁচু টিলার উপর একটি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। সেটিই পরে গোপগড় নামে পরিচিত হয়। যদিও সেই দুর্গের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই। 


বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে গোপগড় ইকোপার্কের প্রদর্শন ফলক থেকে জানা যায়, কংসাবতী নদী তীরবর্তী গোপগড় হল ল্যাটেরাইট সমন্বিত, চ্যাপ্টা মস্তকবিশিষ্ট উচ্চভূমি। এই উচ্চভূমির প্রান্তদেশ খুবই খাড়া এবং ছোট ছোট নালি (Rill) এবং খাত (Gully) দ্বারা ব্যবচ্ছিন্ন। প্রাচীন পলিগঠিত এই উচ্চভূমি ক্ষয় প্রতিরোধ করে কংসাবতী নদীর প্লাবনভূমি থেকে প্রায় ২৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে। গোপগড়ে কোয়াটারনারি যুগের পাললিক শিলার ওপর ল্যাটেরাইট সমতলীকরণ তল গড়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গোপগড়ের উচ্চতা ৬৪.৩০ মিটার (২১১ ফুট)। এই অঞ্চলের বার্ষিক সর্বোচ্চ উষ্ণতা (গড়) ৩৬.৫° C ও বার্ষিক সর্বনিম্ন উষ্ণতা ১৩° C এবং গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫৬ সেমি। গোপগড় ইকোপার্কে মূলত পর্ণমোচী অরণ্য দেখা যায়। এই অঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদগুলি হল : নিম, বকুল, সোনাঝুরি, পলাশ, সেগুন, কাজুবাদাম, ইউক্যালিপটাস, কুসুম, ছাতিম, শাল ইত্যাদি। গোপগড় ইকোপার্কের 'জীববৈচিত্র্য বৃক্ষ' ফলক থেকে জানা যায়, এখানে ৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩০ প্রজাতির প্রজাপতি ও ৬১ প্রজাতির পাখি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রজাপতি প্রজাতিগুলি হল : গ্রাস ইয়েলো, টনি কোস্টার, লাইম সোয়ালোটেইল্, মরমন, কমন টাইগার, লেমন এমিগ্র্যান্ট প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য পাখি প্রজাতিগুলি হল : শালিক, দোয়েল, বুলবুল, ফিঙে, পিউ কাঁহা বা পাপিয়া, পেঁচা, কোকিল, ছাতারে প্রভৃতি। 


সবুজে মোড়া, ইতিহাস সমৃদ্ধ গোপগড় ইকোপার্ক পিকনিক বা বনভোজন, প্রকৃতিকেন্দ্রিক বিনোদন, ট্রেকিং বা হাইকিংয়ের জন্য আদর্শ স্থান। গোপগড় ইকোপার্কের প্রধান দ্রষ্টব্যগুলি হল : (১) গোপগড় হেরিটেজ হাউস : গোপগড়ের প্রধান ঐতিহাসিক স্মারক গোপগড় হেরিটেজ হাউস। ছোটো লাল ইটের (প্রায় ১.৫-২ ইঞ্চি) তৈরি এই অট্টালিকা বর্তমানে জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়নি এখনও। এই অট্টালিকার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। গোপগড় ইকোপার্কের ফলকে এই অট্টালিকাকে লোকস্মৃতি মতে 'বিরাট রাজার স্মৃতি বিজড়িত স্থান' বর্ণনা করা হয়েছে৷ তবে, মেদিনীপুরের ইতিহাস গবেষক চিন্ময় দাশের মতে, ‘হেরিটেজ ভবন’-এর তকমা প্রাপ্ত লাল ইটের ভাঙাচোরা এই অট্টালিকা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। শোনা যায়, তেলিনিপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কোনও এক জমিদার বাগানবাড়ি হিসেবে বাড়িটি বানিয়েছিলেন। (২) ওয়াচ টাওয়ার : গোপগড় ইকোপার্কের ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো এলাকার রোমাঞ্চকর দৃশ্যপট দেখা যায়। দেখা যায়, দূরে বয়ে চলা কংসাবতী নদী এবং রেলসেতু। (৩) ফুলের বাগান : শীতকালে রঙিন সমস্ত ফুলের সমাহার গোপগড় ইকোপার্কের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। ১০-১২ রকমের গোলাপ, ডেইজি, ল্যাভান্ডার, গাঁদা, সূর্যমুখী, লিলি, ডালিয়া ইত্যাদি ফুল এবং ফুলের বাগানে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির দল আপনাকে মুগ্ধ করবে৷ (৪) গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল স্টেশন : ব্রিটিশ যুগে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে যে গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে (১৮০২-১৮৭১) করা হয়েছিল, তারই একটি স্টেশন গোপগড়ে রয়েছে। পিরামিড আকৃতির এই গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল স্টেশনে গোপগড়ের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা এবং উচ্চতার উল্লেখ রয়েছে। (৫) প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য : যেকোনো ইকোপার্কের মতো গোপগড়েও অন্যতম দ্রষ্টব্য প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। গোপগড় ইকোপার্কে প্রজাপতি ও পক্ষী বৈচিত্র্য দেখার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি সম্পর্কে যে কারও জ্ঞান ও উৎসাহ বাড়বে৷ এছাড়া জঙ্গলের বুক চিরে সরু পথ বেয়ে 'ট্রেইলিং'-ও বেশ আকর্ষণীয়। গোপগড় ইকোপার্কের অন্যান্য আকর্ষণগুলি হল : প্রজাপতি উদ্যান, অর্কিডেরিয়াম, রঙিন মাছের মৎস্যাধার, সেলফি জোন প্রভৃতি। 


শীতকালে বিশেষত বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষে গোপগড় ইকোপার্কে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। পর্যটকদের জন্য গোপগড় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (WBSFDA)-এর দুটি কটেজ (পথিক ও প্রিয়া) রয়েছে। গোপগড় ইকোপার্কে একটি সভাকক্ষ ও শিশু উদ্যান রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫:৩০ টা অবদি গোপগড় ইকোপার্ক খোলা থাকে। পার্কিং এরিয়া, ফুড কোর্ট (টিফিন স্টল), পিকনিক স্পট প্রভৃতির সুবিধা রয়েছে। ৬ বছরের উর্দ্ধে জনপ্রতি প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। এছাড়া পিকনিক, যানবাহন, ক্যামেরা ও শ্যুটিং ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত মূল্য লাগে। গোপগড় ইকোপার্ককে আরও আকর্ষণীয় করতে টয়ট্রেন, রোপওয়ে সহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিহাস, জনশ্রুতি আর প্রকৃতির মিশেলে গোপগড় ইকোপার্ক এক জনপ্রিয় 'শর্ট ট্যুর ডেস্টিনেশন'। দিনের শেষে, সন্ধ্যা নামার মুখে যখন পাখিরা নীড়ে ফেরে, তখন গোপগড়ের পুরোনো স্মৃতিগুলি জীবন্ত রূপ ধারণ করে এক অসামান্য নির্জনতায়।

***************************************

তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; গোপগড় ইকো ট্যুরিজম পার্ক - আনন্দরূপ নায়েক (৩১ শে জুলাই, ২০২২), Midnapore.in ; বর্তমান পত্রিকা ; WBSFDA Ecotourism ; এই সময় ; West Bengal Heritage Commission, Government of West Bengal ; Official Website of Paschim Medinipur District, Government of West Bengal

No comments:

Post a Comment