Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Wednesday, 1 September 2021

“এলিয়েন দ্বীপ সোকোত্রা”

 


এলিয়েন শব্দটি শোনা মাত্রই আমাদের মস্তিষ্কে ভাসে আজব সব চিত্র। যা আমাদের পৃথিবীর সাধারণ সব চিত্র থেকে একেবারে ভিন্ন। এই জায়গাটির গাছ-পালা পশু  পাখি সব কিছুই আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরের মতো।এমন আজব বা রহস্যময় একটি জায়গার নাম সোকোত্রা দ্বীপ।


সোকোত্রা আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত। ভৌগোলিক পরিবেশ এবং গাছপালার অদ্ভুত দর্শনের কারণে এই দ্বীপকে ভিনগ্রহবাসীদের দ্বীপ বা ‘এলিয়েন দ্বীপ’ বলা হয়ে থাকে। দ্বীপ বললে ভুল বলা হবে, কেননা সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ আরব সাগরের চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলোর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে ইয়েমেনের ভেতরে।

মধ্য প্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ। সোকোত্রাই আয়তনে সবচেয়ে বড়। সুকাত্ররর আয়তন প্রায় ৬৫৬০ বর্গকিলোমিটার। ইয়েমেন ২০১৩ সালে এটিকে একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এটা হর্ন অফ আফ্রিকা থেকে ২৪০ কিলোমিটার (১৫০ মাইল) পূর্ব এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ৩৮০ কিলোমিটার (২৪০ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। এর স্থানাঙ্ক ১২°৩০′৩৬″ উত্তর ৫৩°৫৫′১২″ পূর্ব। ৩,৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার ভূমি বিশিষ্ট এ দ্বীপপুঞ্জ দৈর্ঘ্যে ১৩২ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৫০ কিলোমিটার। প্রদেশটির রাজধানীর নাম হাদিবু।


আজব বা রহস্যময় দ্বীপ সোকোত্রা। এখানে তেমন কোনো আজব ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি, তবে দ্বীপটি নিজেই যেন অপার্থিব রহস্যে ভরপুর। এখানকার জীবজগৎ, প্রাণীকুল কোন কিছুর সাথেই পৃথিবীর অন্য কোন স্থানের কোনো মিল নেই। যেমন অদ্ভুত দর্শনের গাছপালা এখানে, তেমনিই অদ্ভুত এখানকার পশুপাখি। এখানকার সবকিছু এত অদ্ভূত দর্শনের যে এই দ্বীপকে ভিনগ্রহের কোনো জায়গা বললে মোটেই ভুল হবে না। আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত এই দ্বীপ যেখানে এলিয়েনদের দেখা না মিললেও ভৌগোলিক পরিবেশ এবং গাছপালার ভিন্নতার জন্যই নাম হয়েছে “এলিয়েন দ্বীপ”।


ভৌগলিকভাবে দ্বীপটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সারাবছরই এখানে হালকা বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালে এই বৃষ্টিপাতের পরিমান বেড়ে যায়। সারাবছরই দ্বীপের তাপমাত্রা মোটামুটি স্থিতিশীল। গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত যেকোনও সময় এখানে এলে দেখা যাবে একধরনের কুয়াশা সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাজুড়ে সবসময় এক কুহেলিকার আবরণ তৈরি করে রেখেছে।


এ দ্বীপের বেশিরভাগ উদ্ভিদই স্থানীয়। এ দ্বীপের বেশিরভাগ উদ্ভিদই এন্ডেমিক। পৃথিবীর কোথাও এগুলোর দেখা মেলে না। এই স্থানীয় উদ্ভিদগুলো গড়ন এতটাই অদ্ভুত যে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না।

উদ্ভিদগুলোর অদ্ভুত গড়নই এই দ্বীপকে ভিনগ্রহীদের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করার মূল কারণ। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের জীববিজ্ঞানীগণ জরিপ করে প্রায় ৭০০ প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ পেয়েছেন সারা পৃথিবীতে। আর সোকোত্রা দ্বীপে ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩০৭টি প্রজাতিই স্থানীয়, অর্থাৎ প্রায় ৩৭ শতাংশ উদ্ভিদ আপনি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাবেন না। ২০০৪ সালে IUCN এর লাল তালিকায় সোকোত্রার ৩টি অতিবিপন্ন এবং ২৭টি বিপন্ন উদ্ভিদের নাম রয়েছে।


এই দ্বীপের সবচেয়ে অদ্ভুত গাছ হলো ড্রাগন-ব্লাড ট্রি। এই গাছটি দেখতে একেবারে ব্যাঙের ছাতার মতো। উচ্চতায় বড়জোড় ৭-৮ ফুট। অদ্ভুত গড়নের ছাতাকৃতির এই গাছটি থেকে লাল বর্ণের আঠালো পদার্থ বের হয়। কথিত আছে বহুকাল আগের ড্রাগনের রক্ত থেকে এই গাছের উৎপত্তি এবং সে অনুযায়ী এর নামকরণ! এই গাছের আঠা রঙ তৈরিতে এবং বার্নিশের কাজে ব্যবহৃত হয়।


আরেকটি বিশেষ উদ্ভিদ হলো ডেন্ড্রোসসিয়াস নামক এক প্রকারের শশা গাছ। বিভিন্ন আকৃতির কান্ডটি লম্বা হয়ে চূড়া তৈরি করে, যেখানে হলুদ, গোলাপী ফুল ফোটে। উভলিঙ্গ এই গাছের জন্ম এই দ্বীপের বয়সের দ্বিগুণ আগে বলে গবেষকদের ধারণা। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এদের বংশবিস্তারের অনুকূল।


এছাড়াও রয়েছে পোমেগ্র্যানেট নামক ফুলের উদ্ভিদ। এটি আড়াই থেকে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সাধারণত ফুল এবং ফল হয়। ফুলগুলো সাধারণত গোলাপি বা লালের কাছাকাছি রঙের হয় আর ফল পাকলে তা হলদে-সবুজ রঙ ধারণ করে। এই গাছের কাঠ খুব শক্ত হয় এবং ছোটখাট আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃতও হয়। এই গাছটি সোকোত্রার বিশেষ উদ্ভিদ হলেও হাওয়াইতে দ্বীপে চাষের চেষ্টা চলছে।


এমন অদ্ভুত দেখতে গাছ খুব একটা চোখে পড়েছে কি? আরব সাগরের বুকে একটি দ্বীপে এমন আরও অনেক বিচিত্র দর্শন গাছ রয়েছে যেগুলিকে দেখলে সত্যজিৎ রায়ের লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলির কথা মনে পড়ে যেতে পারে। প্রফেসর শঙ্কুর নানা অভিযানের মধ্যে এমন অনেক বিচিত্র গাছের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এই দ্বীপে এলে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের বিচিত্র দর্শন গাছপালা চোখের সামনে দেখতে পাবেন।

২০০৮ সালে ইউনেসকো এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়। এই সোকোত্রা দ্বীপের বিচিত্র দর্শন গাছপালাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ড্রাগন-ব্লাড, ডেন্ড্রোসসিয়াস, পোমেগ্র্যানট। এই দ্বীপে এলে চারপাশের পরিবেশ আর গাছপালা দেখে আপনার মনে হতেই পারে যে, আপনি হয়তো অন্য কোনও গ্রহে এসে পড়েছেন!


স্কিংস, পা-বিহীন টিকটিকি, নানা প্রকারের মাকড়শা এবং তিন প্রকারের কাঁকড়ার দেখা মেলে এ দ্বীপে। স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে মানুষ ও বাদুড় ছাড়া আর কোনো প্রাণীর সন্ধান মেলেনি।


দ্বীপটি তেমন জনবহুল নয়। সোকোত্রায় বর্তমানে ছশোটি গ্রামে প্রায় ষাট হাজার মানুষ বসবাস করে। দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী হাবিদু শহরেই সবচেয়ে বেশি লোক বাস করে। দ্বীপে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকই স্থানীয়।


কি ভাবছেন ? একবার ঘুরে দেখবেন নাকি, এই "এলিয়েন দ্বীপ সোকোত্রা"। চাইলে আপনি যেতেই পারেন জাহাজে করে আরব সাগর দিয়ে তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস বাদে বছরের অন্যান্য সময়ে। অথবা বিমানে সোকোত্রা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। 

এখানে গণপরিবহন ব্যবস্থা খুবই সামান্য। দুই-একটি মিনিবাসের দেখা মিলতে পারে। তাছাড়া আপনি চাইলে গাড়িও ভাড়া করতে পারেন। পরিবহন ব্যবস্থা নগণ্য হবার প্রধান কারণ এই এলাকার বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম। গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহারে খুব বাজেভাবে ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় হয়তো আপনাকে পায়ে হেঁটেই চলতে হতে পারে।


তথ্যসূত্র:

Wikipedia, goggles.blog, আটপৌরে, Roarmedia, Zee24Ghanta, DurbinNews.


লেখক:

অয়ন বিশ্বাস

ঘোড়ালিয়া,শান্তিপুর,নদিয়া।

“ডিম পাড়া পাহাড়” বা এগ্ মাউন্টেইন

 


শিরোনাম পড়ে হয়তো অবাক হয়েছেন একটি পাহাড়ে আবার কীভাবে ডিম পাড়ে? হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন এমনই এক পাহাড় রয়েছে আমাদের দেশের খুব পাশেই। এই পাহাড়ের আঞ্চলিক নাম “চান দান ইয়া” (Chan Dan Ya)। এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় “ডিম পাড়া পাহাড়” (egg mountain)। 


আমাদের প্রতিবেশী দেশ চিনে পাহাড়টি দেখতে পাবেন (china)। এই পাহাড়টি আসলে গানডেং পর্বতশ্রেণীর একটি অংশ (Mount Gandeng)।

চীনের গুউঝু প্রদেশের কিয়ানান বুয়ী ও মিয়াও অঞ্চল জুড়ে এই পাহাড় রয়েছে। 


তবে কোনো পাহাড়ও যে ডিম পাড়ে, একথা জানতেন কি? হ্যাঁ, চীনের গুউঝু প্রদেশের “ডিম পাড়া পাহাড়” (egg mountain) এর যে অংশে আপনি ডিম পাবেন সেটি লম্বায় ৯ ফুট এবং চওড়ায় প্রায় ৬৫ ফুট।এক একটি ডিম পাড়তে নাকি লেগে যায় প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত সময়। এরপর ডিম আস্তে আস্তে পরিণত হতে হতে পাহাড়ের পাদদেশে এসে জমা হয়। তবে ডিমগুলি সত্যিকারের নয়। এগুলি ডিমের মতো গোল ও মসৃণ হওয়ায় একে ডিম ভেবে অনেকেই ভুল করেন। এগুলো আসলে পাথর যা এমন আকার ধারণ করেছে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে।


ডিমের মতোই গড়াতে গড়াতে এসে পড়ে ওই পাহাড়েরই পাদদেশে। সেই জায়গাটা সব সময় ভরে থাকে ডজন ডজন কুচকুচে কালো ডিমে।


এই পাথুরে ডিমগুলো দেখতেও একদম আসল ডিমের মতো মসৃণ আর গোল। কোনোটা আবার একদম ডিম্বাকৃতির। পাথরের ডিম গুলি গাঢ় নীল রঙের ডাইনাসরের ডিমের মতো হয়ে থাকে। ডিম এর আয়তন ১১.৮ ইঞ্চি থেকে ২৩.৬ ইঞ্চি এবং ওজন ৬৬০ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে।


কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, একটি পাহাড় কিভাবে ডিম পাড়ে? সে প্রশ্নের উত্তর এখনো ঠিকমতো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভূতত্ত্ববিদরা এই প্রশ্নেরত্তর দিতে সত্যি সত্যিই গলদঘর্ম হচ্ছেন।


বিশেষজ্ঞের মতে পর্বতশ্রেণী পাললিক শিলা (sedimentary rock) দিয়ে গঠিত হলেও এই অংশটি তার ব্যতিক্রম কারণ এটি গঠিত হয়েছে চুনাপাথর (limestone) দিয়ে। চুনাপাথর অপেক্ষাকৃত নরম বলে, তা সহজেই ক্ষয় হতে থাকে কিন্তু তাতে যে কঠিন পাললিক শিলার অংশ থাকে, সেগুলো অত সহজে ক্ষয় হয় না। সেগুলি আস্তে আস্তে জমা হতে হতে ডিমের আকার ধারণ করে। ডিমের আশপাশের অংশ যত ক্ষয় হতে থাকে, ডিমও তত বড় হতে থাকে। তারপর পুরো ডিম হয়ে গেলে, আশপাশের অংশের ক্ষয়ে যাওয়া এবং ডিমের ওজন বেড়ে যাওয়া মিলিয়ে সেটি টুক করে খসে পড়ে এবং পাহাড়ের পাদদেশে এসে জমা হয়।

তবে এমন ডিমের মতোই গোল কি করে হতে পারে পাথরগুলি তা ভাবার বিষয়।


 সেখানে যে চুনাপাথর (limestone) স্তর রয়েছে তা সৃষ্টি হয়েছিল সেই কেমব্রিয়ান যুগে,  প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে। সেগুলো এখনও কি করে অক্ষত রয়েছে সেটি  একটি প্রাকৃতিক রহস্য।


সেখানকার মানুষের কাছে কিন্তু এসবের ব্যাখ্যা খুব সহজ। তাদের কাছে এই ডিমগুলো ঈশ্বরের দান।


 পাহাড়টির কাছেই একটি গ্রাম আছে, যার নাম গুলু।সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা এই পাথরগুলিকে ঈশ্বরের দান বলে মনে করেন।

তারা রীতিমতো পুজো অর্চণা  করেন এই পাথরের টুকরোগুলিকে। এমনকি এক একটি বাড়িতে একটি করে এমন ডিমও দেখতে পাবেন আপনি।


বর্তমানে এই ডিম ভর্তি পাহাড়ের আকর্ষণে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হওয়ায় ডিমগুলোকে নাকি চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ আবার ডিমগুলো খসে পড়ার অনেক আগেই তা চুরি করে নেয় অধিক মুনাফার আশায়।


তথ্যসূত্র:

kolkata24x7.com

adwitiya.net.in Dailymail.co.usa

গঙ্গার ডলফিন শুশুক

 

গঙ্গা নদীর শুশুক (Ganges River Dolphin) শান্ত, নিরীহ জলজ প্রাণী। এই শুশুক প্রজাতি প্রাথমিকভাবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী ও বাংলাদেশ ও নেপালে প্রবাহিত তাদের শাখানদীগুলোতে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ত দেখা যায়। স্বাদু জলের শুশুক  ডলফিনের একটি প্রজাতি। শুশুক  ডলফিন ও তিমির নিকট জ্ঞাতি, একান্তভাবে সামুদ্রিক কয়েকটি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রকৃতপক্ষে এগুলি Cetacea বর্গের Phoeconidae গোত্রের অন্তর্গত ছোট দাঁতের তিমি। এদের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা’ (দক্ষিণ এশীয় রিভার ডলফিন)। জাতীয় জলজ প্রাণীর তকমা মিলেছে। ঢুকে পড়েছে বিপন্নের তালিকায়।

 

 বাদামি বা কালো বর্ণের এই প্রাণীটি অবাধে মিঠে জলে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় অন্ধ শুশুক পুরুষদের দৈর্ঘ্য দুই থেকে আড়াই মিটার এবং স্ত্রীদের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই মিটার। মাংশাসী প্রাণীটি খাবার হিসেবে মাছ এবং অন্য ছোট জলজ প্রাণীদের ভক্ষণ করে। প্রাণীটির নাসারন্ধ্রে একটি নরম মাংসপিণ্ড রয়েছে, এর নাম ‘বার্সা’; এর সাহায্যে এরা শব্দ উৎপন্ন করতে পারে।  এদের ঘ্রাণশক্তি তীব্র। এদের পুরো দেহ চর্বির আস্তরণে আবৃত, এই আস্তরণ ‘ব্লাবার’ নামে পরিচিত। এর কাজ হল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করা ও দেহকে গরম রাখা। শুশুকের মুখের সামনে রয়েছে একটি লম্বা ‘রস্ট্রাম’ যা তারা ‘ইকো-লোকেশন’-এর কাজে লাগায় ও শিকার ধরে। প্রাণীটির চোয়ালে রয়েচে ২৭ থেকে বত্রিশটি ছোট ছোট দাঁত যা আত্মরক্ষা, শিকার ধরার কাজে লাগে। শুশুকের শরীর মাথা থেকে লেজের দিকে ক্রমশ সরু, মজবুত অগ্রপদ ফ্লিপারে (Flipper) রূপান্তরিত হয়েছে, লেজের পাতাগুলি আনুভূমিক। দেহের মধ্যভাগে অবস্থিত সুবিকশিত পৃষ্ঠপাখনা (ব্যতিক্রম পাখনাহীন শুশুক Neophocaena phoeaenoides)। সব জাতের শুশুকই ঠোঁটবিহীন ও দুই চোয়ালেই একই রকম চেপ্টা চামচের মতো দাঁত। এদের পশ্চাৎপদ নেই,  দেহ সম্পূর্ণ লোমহীন। দুটি নাসারন্ধ্র মিলে একটি নাসিকাগহবর গঠিত হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে সরাসরি জলের উপরের বাতাস ব্যবহার করে। এরা যখন ভেসে ওঠে তখন বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে ও শ্বাস নেয়।


শুশুকদের প্রধান খাদ্য মাছ। শিকারের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এরা অতিদ্রুতগামী শব্দ সংকেত ব্যবহার করে। এদের তৈরি শব্দ লক্ষ্যবস্ত্তকে আঘাত করলে তার প্রতিধ্বনি দ্রুত শুশুকের কাছে ফিরে আসে। এ থেকে শুশুক তাৎক্ষণিকভাবে শিকারের আকার, দূরত্ব গতিবিধি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। এরা সমাজবদ্ধ প্রাণী, প্রায়ই দলবেঁধে চলাচল করে এবং শব্দ সংকেতের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।


পুরুষ এবং স্ত্রী শুশুক একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করে এবং কখনওই এরা একা থাকে না। কিন্তু বর্তমানে গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় এদেরকে একা একা ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টি পশুপ্রেমীদের কাছে এক অশনিসঙ্কেত বহন করে আনছে। প্রায় এক বছর গর্ভধারণের পর শুশুক একটি সন্তান প্রসব করে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে, তাদের জন্মহারের থেকে গত কয়েক দশকে মৃত্যুহার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। গঙ্গার শুশুকদের বাৎসরিক মৃত্যুহার ১৫০ থেকে ১৬০। 


গাঙ্গেয় শুশুক তথা ডলফিন জাতীয় জলজ প্রাণীর মর্যাদা পেয়েছে ২০১০ সালে। কিন্তু জাতীয় জলজ প্রাণীর হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরে এদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা নিয়মিত। জাতীয় জলজ প্রাণীর তকমা মিলেছে, কিন্তু আজ তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ঢুকে পড়েছে বিপন্নের তালিকায়। একটা সময় দেখা যেত, গঙ্গার বুকে মাঝেমধ্যেই ভেসে উঠত শুশুক। আবার পরক্ষণেই জলে ডুব দিত।  এই সুন্দর দৃশ্য একটা সময় শিশুরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত।


 ‘ওরা বসত করে ক’জনা’, তা রাজ্যের বন দফতরের অজানা। ‘ওরা’ গাঙ্গেয় ডলফিন, চলতি কথায় শুশুক। জলের দূষণ, জেলের জাল, নদীর বাঁধ ও মানুষের অত্যাচারে এই নিরীহ প্রাণীগুলো লুপ্ত হওয়ার পথে। শুশুক বাঁচাতে বহু দিন ধরে আন্দোলন করছে দেশের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, গত কয়েক দশকে গঙ্গায় শুশুকের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। আইইউসিএন-এর ‘রেড ডেটা বুক’ অনুসারে আজ তারা বিপন্নের তালিকাভুক্ত। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ বা ডব্লিউ ডব্লিউ এফ-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গঙ্গায় চরম দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য শিকারের কারণে এদের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। চোরাশিকারিদের অবাধ বিচরণ এবং যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত বাঁধ তৈরির কারণে এদের সংখ্যা উদ্বেজনক ভাবে কমছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধি। 


সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে,  বিহার সরকারের অনুদানে ‘জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’, ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া’ এবং ভাগলপুরের টিলকামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে হাজার কিলোমিটার অঞ্চল বরাবর গঙ্গার শুশুকদের উপরে সমীক্ষা চা‌লানো হয়। এতে প্রায় ১,১৫টি০ শুশুকের সন্ধান মিলেছে। ২০০৫ সালে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬০০। অথচ ১৯৮২ সালের গণনা অনুসারে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে তাদের সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। গত শতকের এক সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো। এদের সংখ্যা হ্রাসের কারণে জলজ বাস্তুতন্ত্রে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বে গাঙ্গেয় শুশুকের সংখ্যা মেরেকেটে ১,২০০ থেকে ১,৮০০। ২০১৭ সালে হুগলি নদীতে এই প্রজাতির শুশুকের সংখ্যা চিহ্নিত করে তাদের অস্তিত্ব সংকট সম্পর্কে সবিস্তারে রিপোর্ট দিয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড-এর (WWF) গবেষক দল। নদীর দূষিত জলে তাদের টিকে থাকার লড়াই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন পরিবেশবিদরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাদের সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্টই কাজ করেছে। শুশুকদের উপরে সর্বক্ষণ নজরদারির জন্য গঙ্গার ফরাক্কা থেকে ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি হয়েছে রাজ্য সরকার ও ডব্লিউডব্লিউএফ-এর উদ্যোগে। প্রথম ভাগে রয়েছে ফরাক্কা ও ফিডার ক্যানাল, দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে বেলুড় মঠ, বর্ধমান এবং নবদ্বীপ লাগোয়া গঙ্গার অংশ। তৃতীয় ভাগে রয়েছে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, এবং চতুর্থ ভাগে রয়েছে কোলাঘাট অঞ্চল। পঞ্চম ভাগে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার ও তার লাগোয়া এলাকা। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী, মৎস্যজীবী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে শুশুকদের সংরক্ষণের কাজে, তা না হলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে গঙ্গার বুকে ভয়াবহ কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে। রাজ্য বনদপ্তরের উদ্যোগে ভাগীরথী ও অজয নদের সংযোগস্থলে রাজ্যের প্রথম গাঙ্গেয় শুশুক সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হল পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায। 


কেন্দ্র গাঙ্গেয় শুশুক ও সামুদ্রিক ডলফিন, উভয় প্রাণীকেই সংরক্ষণ করবে। ‘প্রোজেক্ট ডলফিন’ একটি বহুমুখী প্রকল্প। এতে শুধু সংরক্ষণ নয় নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও পর্যটন ক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনাও বাড়ার আশা। 




Wikipedia, প্রথম আলো, Hindustan Times Bangla, এইসময়, Banglapedia, আনন্দবাজার পত্রিকা

নিশীথ সূর্যের দেশ : নরওয়ে


একবার ভেবে দেখুন তো, যদি কোথাও ৬ মাস সূর্য ওঠে আর বাকি মাসগুলো অন্ধকারে থাকে, সেখানকার অবস্থা কেমন হবে? আবার এমনো হতে পারে, মধ্যরাতে হঠাৎ সূর্য উঠেছে আকাশে, তখন আপনার কেমন দশা হবে? তেমনই এক দেশ হলো নরওয়ে। এটি পৃথিবীর এমন একটি দেশ যেখানে মধ্যরাতে সূর্য ওঠে। সবসময় এমন ঘটনা না ঘটলেও বছরের বেশ কিছু সময়ে অনাকাঙ্খিত এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন সেখানকার জনগণ। এ ছাড়াও নরওয়ে সম্পর্কিত এমন অনেক তথ্য আছে; যেগুলো জানলে আপনি রীতিমতো অবাক হয়ে যাবেন!


নরওয়ে ইউরোপ মহাদেশের একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। এটি সরকারিভাবে নরওয়ে রাজ্য হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এ দেশটি মূলত মধ্যরাতের সূর্যের দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন আছে নরওয়েতে। সেখানকার প্রতিটি স্থান দেখলে মনে হবে, রূপকথার একেকটি রাজ্য।


পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের দেশ নরওয়ে। ৬০ ডিগ্রি অক্ষাংশে অবস্থিত নরওয়ের রাজধানী অসলোয় জুন-জুলাই মিলিয়ে দু’মাস সবসময় দিনের আলো থাকে। অর্থাৎ এ সময়ে এখানে সূর্য অস্ত যায় না। এর ফলে এ সময় রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে গোধূলির আলো দেখা যায় সারারাত।




বিশ্বব্যাপী নরওয়ে দেশটির পরিচিতি মধ্যরাতের সূর্যের দেশ বা নিশীথ সূর্যের দেশ  হিসেবে।  অর্থাৎ মধ্যরাতেও এই দেশটিতে সূর্যের দেখা মেলে। শুনতে অবাক লাগছে তাইনা? সূর্য তাও আবার মধ্যরাতে! অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে আকাশে সূর্য রয়েছে তাহলে দিন না হয়ে রাত কেন? অথবা রাতের বেলা আকাশে সূর্যই বা দেখা যাবে কি করে? আসলে, মধ্যরাতের সূর্য হচ্ছে এমন একটা ঘটনা যখন টানা ২৪ ঘন্টাই সূর্য দিগন্ত রেখার উপরে থাকে এবং ঐ সকল অঞ্চল সমূহ ২৪ ঘন্টা ই সূর্যের আলো পেয়ে থাকে। আবার একই ভাবে সূর্য যখন দিগন্ত রেখার নিচে অবস্থান করে তখন ঐ অঞ্চল সমূহে ২৪ ঘন্টাই রাতের অন্ধকার থাকে। চলুন তাহলে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক এই বিষয়ে-


পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত নরওয়ের প্রাকৃতিক ঘটনা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ২৪ ঘন্টা ব্যাপী সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকা। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে নরওয়ের কিছু অঞ্চলে ২ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত একটানা সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকে এবং রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে আকাশে গোধূলির আলো ফুটে থাকে। নরওয়ে ছাড়াও উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত কয়েকটি দেশ যেমনঃ সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডেও একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু নরওয়েরই বেশিরভাগ অঞ্চল উত্তর গোলার্ধের মধ্যে অবস্থিত এবং সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। আর এই কারনেই নরওয়ে মধ্যরাতের সূর্যের দেশ বা 'নিশীথ সূর্যের দেশ' হিসেবে পরিচিত।


২৪ ঘন্টা সূর্যের আলো থাকার কারণ হচ্ছে নরওয়ের ভৌগোলিক অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল তখন সুমেরু বৃত্ত থেকে যত উত্তরে বা উপরের দিকে যাওয়া যায় ততই সূর্যের আলো বেশি সময় ধরে পাওয়া যায়। উত্তর গোলার্ধের সর্বোচ্চ স্থান বা সর্ব উত্তরে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস সূর্য আলো দেয় এবং তার পর ৬ মাস অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। অর্থাৎ এই ৬ মাস উত্তরগোলার্ধে শীতকাল বিরাজ করে। নরওয়ের সালবার্ড (Svalbard) দ্বীপপুঞ্জ উত্তর গোলার্ধের জনসংখ্যা অধ্যুষিত সর্ব উত্তরের স্থান। এই অঞ্চলে ১৯ শে এপ্রিল থেকে ২৩ শে আগষ্ট পর্যন্ত একটানা প্রায় ৪ মাস সূর্য আলো দেয়। এছাড়াও অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন স্থানে ২-৩ মাস পর্যন্ত একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। তবে মধ্যরাতের সূর্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায় ২১ জুন।


প্রাকৃতিক এই ঘটনাটিকে হোয়াইট নাইট বা শ্বেতরাত্রি বলা হয়। কারণ এই সময় স্বাভাবিক নিয়মে সূর্য উঠলেও তা অস্ত না গিয়ে দিগন্ত রেখার উপরে অবস্থান করে এবং রাতের বেলাও আকাশকে মৃদু আলোয় উদ্ভাসিত রাখে।



প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই অনন্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে নরওয়েতে আসেন।


বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটির পরিচিতি মূলত মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে থাকলেও এটি ছাড়াও এই দেশটির বিশেষত্ব হিসেবে রয়েছে এর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেমন- রুপকথার গল্পের মত সুন্দর সব সমুদ্রখাত, অরোরা বোরিয়ালিস বা উত্তরের আলো, তুষার ঢাকা বিস্তৃত মালভুমি আর অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা।


মধ্যরাতের সূর্যের মত আরও একটি মনোমুগ্ধকর ঘটনা হচ্ছে রাতের আকাশ জুড়ে বর্ণময় আলোর খেলা, যা অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ণ লাইটস নামে পরিচিত। নরওয়েতে গ্রীষ্মকালে ৬ মাস যেমন সূর্যের আলো থাকে ঠিক তেমনই শীতকালে এই অঞ্চলটি অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। আর এই সময়েই দেখা মেলে অরোরা বোরিয়ালিস বা সুমেরুপ্রভা। এই মহাজাগতিক আলোর খেলা সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত অন্ধকার রাত্রিতে দেখতে পাওয়া যায়। সাধারনত উচ্চ অক্ষাংশ অঞ্চল সমূহে এই ঘটনা দেখা যায় এবং নরওয়ে ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য মেরু অঞ্চলেও অরোরা দেখতে পাওয়া যায়।


নরওয়ের অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আরেকটি উৎস হল সামুদ্রিক খাড়ি যা ফিয়র্ড নামে পরিচিত। সংকীর্ণ খাড়ি গুলো মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করে যা পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। 


নরওয়েতে রয়েছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এ সকল হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ। ইউরোপের সবচেয়ে গভীর হ্রদ Hornindalsvatnet নরওয়েতে অবস্থিত । এই হ্রদের আয়তন ৫১ বর্গ কি.মি., গভীরতা ৫১৪ মিটার (১৬৮৬ ফুট)। এর উপরিভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৩মি. (১৭৪ ফুট) উচুতে এবং তলদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৬১ মি. (১৫১২ ফুট) গভীরে।


নরওয়ের সৌন্দর্য্যের আধার বলা হয় উত্তর নরওয়েতে অবস্থিত লোফোটেন দ্বীপপুঞ্জকে। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বেলাভূমি থেকে শুরু করে সুউচ্চ পর্বত শ্রেণি, রহস্যময় সমুদ্র খাড়ি, ছবির মত সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ। এখানে একটি ভাইকিং মিউজিয়ামও রয়েছে যা ভাইকিং ইতিহাসের বিভিন্ন সাক্ষ্য বহন করে। নরওয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য নয়, এর ইতিহাস এবং বর্ণীল সংস্কৃতির জন্যও সুপরিচিত। নরওয়ের শহর এবং নগরগুলো সার্বজনীন এবং নজর কাড়া স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্থাপত্যে ভরপুর। নরওয়ের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে ফ্রেডরিকস্ট্যাড দূর্গ, স্ট্যাইভ চার্চ, নিডারোস ক্যাথেড্রাল, জার্মান স্থাপনার আদলে তৈরি বাণিজ্যিক ভবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও নরওয়েতে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ পথ যা ২৪.৫ কি.মি. দীর্ঘ। 


নরওয়ের প্রাণী বৈচিত্র্যও অসাধারন এবং অবিশ্বাস্য। এখানে রয়েছে তুষার শুভ্র সুমেরু শিয়াল থেকে শুরু করে বল্গা হরিণ, তিমি, সাদা লেজ যুক্ত ঈগল, মেরু ভালুক, সিন্ধু ঘোটক এবং আরও অনেক ধরনের প্রাণী। আর্কটিক ল্যান্ডস্কেপ, উত্তরে বনাঞ্চল আর জটিল উপকূল ভূমির কারণে উত্তর নরওয়েতে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়া যায়।


 তথ্যসূত্র:

Wikipedia, Quora, myfuturepoint, techtunes, ইতিবৃত্ত, রোদ, বাংলাদেশ জার্নাল, Jagonews24

ভারতে জাতীয় পাখি : ময়ূর

 

ময়ূর (Peafowl) ফ্যাজিয়ানিডি (Phasianidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত সুন্দর এক পাখি। এশিয়ায় পাভো (Pavo) গণে মোট দুই প্রজাতির এবং আফ্রিকায় আফ্রোপাভো (Afropavo) গণে একটি ময়ূরের প্রজাতি দেখা যায়। এশিয়ায় প্রাপ্ত ময়ূরের প্রজাতি দু’টি হল নীল ময়ূর আর সবুজ ময়ূর। এই নীল ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি।



আমাদের সকলেরই ময়ূরের সঙ্গে কম বেশী পরিচিতি আছে। পুরুষ পাখি 'ময়ূর' এবং স্ত্রী পাখি ‘ময়ূরী’ নামে পরিচিত। ময়ূর বৈচিত্রময়, রঙিন, রাজহাঁসের মতো বড় পাখি, পাখার মতো ঝুঁটিবিশিষ্ট, চোখের নীচে সাদা দাগ এবং লম্বা ও সরু গলাবিশিষ্ট। এই জাতের মধ্যে পুরুষগুলি নারীদের থেকে বর্ণময় হয়, নীল চকচকে বুকের দিক ও ঘাড়, দর্শনীয় ব্রোঞ্জ-সবুজ লেজ, যাতে প্রায় ২০০ টির মত লম্বা পালক থাকে। স্ত্রী পাখিরা বাদামি ধরনের, আকৃতি একটু ছোট হয় এবং লেজ থাকে না। পুরুষ ময়ূর দেখতে খুব সুন্দর হলেও এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ময়ূরের ডাককে বলা হয় কেকা। স্ত্রী ময়ূরকে আকৃষ্ট করার জন্যই পুরুষ ময়ূর পেখম তোলে। এ কারণেই এরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পাখার মতো লেজ ছড়িয়ে এবং পালক ফুলিয়ে পুরুষদের প্রেম-প্রার্থনার নাচ সত্যিই দেখার মতো। স্ত্রী ময়ূরও পেখম তোলে তবে তা শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য। স্ত্রী ময়ূরের পেখম আকারে অনেক ছোট হয়।


ময়ূর বন্য পাখি। ময়ূরের সব প্রজাতিই সাধারণত বনে বাস করে এবং মাটিতে বাসা বাঁধে। মাটির গর্তে বাস করে কিন্তু গাছে বিশ্রাম করে। তবে মাঝে মাঝে এদের লোকালয়েও দেখা যায়। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকায় এরা মানুষের খুব কাছে চলে আসে। 

 

এরা সর্বভূক প্রাণী। চারা গাছের অংশ, কীটপতঙ্গ, সাপ, বীজের খোসা, ফুলের পাপড়ি এবং ছোট ছোট সন্ধিপদী প্রাণী ইত্যাদি খায়। তবে সংরক্ষিত এলাকায় এরা মাঝে মাঝে খাবারের খোঁজে লোকালয়েও চলে আসে। এরা টিরেস্ট্রিয়াল খাদক শ্রেণীর অন্তরভুক্ত। এরা ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ছোট বাচ্চাগুলো মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। বিপদ দেখলেই মায়ের ডানার নিচে এসে লুকায়। ছোট বাচ্চারা মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের পালকের আড়ালে, আবার কখনোবা পিঠের উপর লাফিয়ে ওঠে। সাধারনত শত্রুর কাছ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য Galliformes বর্গের প্রাণীদের মত এরাও এদের মেটাটারসাল (পায়ের নখর) ব্যবহার করে।


সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখা যায়। ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩ সালে ভারতীয় ময়ূরকে ( Pavo cristatus ) ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ভারত ছাড়াও নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা সহ সমগ্র বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে এই প্রজাতির ময়ূর পাওয়া যায়। সবুজ ময়ূর মায়ানমার থেকে জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতের প্রায় সব অংশে ময়ূরের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে সবুজ ও নীল ময়ূরের পাশাপাশি সাদা ময়ূরও দেখা যায়। এদের দেহ সাদা ও চোখ নীল। প্রকৃতপক্ষে নীল ময়ূরই জিনগত মিউটেশনের কারণে সাদা বর্ণ ধারণ করে। তবে ভারতীয় ময়ূরের মত সাদা ময়ূরের পেখমে সোনালী পালক বা নীল রংয়ের বড় ফোঁটা নেই। সাদা ময়ূর সম্পূর্ণ সাদা।


১৯৬৩ সালে ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হয়, কারণ এটি সামগ্রিকরূপে ভারতের প্রচলিত রীতিনীতি ও সংস্কৃতির এক অংশ ছিল। ময়ূর হল লাবণ্য ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক। ময়ূরকে জাতীয় পাখি রূপে মনোনীত করার আরেকটি কারণ হল সারা দেশ জুড়ে তার উপস্থিতি। এমনকি সাধারণ মানুষও পাখির সঙ্গে খুব বেশিই পরিচিত। তাছাড়াও, এখনও পর্যন্ত আর অন্য কোনও দেশে তাদের জাতীয় পাখি হিসাবে ময়ূর ছিল না। ময়ূর এই সমস্ত কিছুকে পরিপূর্ণ করেছে, অতঃপর ভারতের জাতীয় পাখি হয়ে উঠেছে।


ময়ূরের পালককে অনেকেই মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ভেবে থাকে। সে জন্যই যে কোনো শুভ কাজে বা মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ময়ূরের পালক ব্যবহার করা হয়। ময়ূরকে ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। আর এই কারণেই বাড়িতে ধন-সম্পদের বৃদ্ধি করতে অনেকে বাড়িতে ময়ূরের পালক রাখেন। ময়ূরের পেখম নিয়েও বিভিন্ন  কাহিনী  শোনা যায়। পুরাণ ঘাঁটলে একাধিক পশু পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। বা ধরুন মহাভারত বা রামায়নের মতো একাধিক জায়গায় একাধিক পশু পাখির উল্লখ পাওয়া যায়। ময়ূর সেভাবে এখন দেখা না মিললেও একরকম ভাবে একে প্রেমের প্রতিক মানা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের মুকুটে ময়ূরের পালক লক্ষ্য করা যায়। ময়ূর হল লাবণ্য ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক হলেও বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।


ঐতিহাসিকভাবে প্রজাতিটি মায়ানমারের জাতীয় প্রতীক এবং 1963 সালে ময়ূর, ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষিত হলেও ময়ূর সংরক্ষণের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ময়ূরের পালক বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের জন্য ময়ূর হত্যা ও চোরাশিকারিদের কারণে এদের সংখ্যা উদ্বেজনক ভাবে কমছে। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখা মিললেও বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। পূর্বে বাংলাদেশে এরা বিস্তৃত থাকলেও এখন তা সম্ভবত বিলুপ্ত। বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে বিশ্বব্যাপী এই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে এরা বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত।

 


তথ্যসূত্র:

1) https://bn.vikaspedia.in

2) https://www.onlineshikkhasite.com

3) https://bn.quora.com

4) www.wikipedia.org

5) https://flimandsports.com


লেখক:

অয়ন বিশ্বাস

ঘোড়ালিয়া,শান্তিপুর,নদিয়া।