ময়ূর (Peafowl) ফ্যাজিয়ানিডি (Phasianidae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অত্যন্ত সুন্দর এক পাখি। এশিয়ায় পাভো (Pavo) গণে মোট দুই প্রজাতির এবং আফ্রিকায় আফ্রোপাভো (Afropavo) গণে একটি ময়ূরের প্রজাতি দেখা যায়। এশিয়ায় প্রাপ্ত ময়ূরের প্রজাতি দু’টি হল নীল ময়ূর আর সবুজ ময়ূর। এই নীল ময়ূর ভারতের জাতীয় পাখি।
আমাদের সকলেরই ময়ূরের সঙ্গে কম বেশী পরিচিতি আছে। পুরুষ পাখি 'ময়ূর' এবং স্ত্রী পাখি ‘ময়ূরী’ নামে পরিচিত। ময়ূর বৈচিত্রময়, রঙিন, রাজহাঁসের মতো বড় পাখি, পাখার মতো ঝুঁটিবিশিষ্ট, চোখের নীচে সাদা দাগ এবং লম্বা ও সরু গলাবিশিষ্ট। এই জাতের মধ্যে পুরুষগুলি নারীদের থেকে বর্ণময় হয়, নীল চকচকে বুকের দিক ও ঘাড়, দর্শনীয় ব্রোঞ্জ-সবুজ লেজ, যাতে প্রায় ২০০ টির মত লম্বা পালক থাকে। স্ত্রী পাখিরা বাদামি ধরনের, আকৃতি একটু ছোট হয় এবং লেজ থাকে না। পুরুষ ময়ূর দেখতে খুব সুন্দর হলেও এদের কণ্ঠস্বর কর্কশ। ময়ূরের ডাককে বলা হয় কেকা। স্ত্রী ময়ূরকে আকৃষ্ট করার জন্যই পুরুষ ময়ূর পেখম তোলে। এ কারণেই এরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পাখার মতো লেজ ছড়িয়ে এবং পালক ফুলিয়ে পুরুষদের প্রেম-প্রার্থনার নাচ সত্যিই দেখার মতো। স্ত্রী ময়ূরও পেখম তোলে তবে তা শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য। স্ত্রী ময়ূরের পেখম আকারে অনেক ছোট হয়।
ময়ূর বন্য পাখি। ময়ূরের সব প্রজাতিই সাধারণত বনে বাস করে এবং মাটিতে বাসা বাঁধে। মাটির গর্তে বাস করে কিন্তু গাছে বিশ্রাম করে। তবে মাঝে মাঝে এদের লোকালয়েও দেখা যায়। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকায় এরা মানুষের খুব কাছে চলে আসে।
এরা সর্বভূক প্রাণী। চারা গাছের অংশ, কীটপতঙ্গ, সাপ, বীজের খোসা, ফুলের পাপড়ি এবং ছোট ছোট সন্ধিপদী প্রাণী ইত্যাদি খায়। তবে সংরক্ষিত এলাকায় এরা মাঝে মাঝে খাবারের খোঁজে লোকালয়েও চলে আসে। এরা টিরেস্ট্রিয়াল খাদক শ্রেণীর অন্তরভুক্ত। এরা ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ছোট বাচ্চাগুলো মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। বিপদ দেখলেই মায়ের ডানার নিচে এসে লুকায়। ছোট বাচ্চারা মুরগির বাচ্চার মতই মায়ের পালকের আড়ালে, আবার কখনোবা পিঠের উপর লাফিয়ে ওঠে। সাধারনত শত্রুর কাছ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য Galliformes বর্গের প্রাণীদের মত এরাও এদের মেটাটারসাল (পায়ের নখর) ব্যবহার করে।
সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখা যায়। ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩ সালে ভারতীয় ময়ূরকে ( Pavo cristatus ) ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ভারত ছাড়াও নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা সহ সমগ্র বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশে এই প্রজাতির ময়ূর পাওয়া যায়। সবুজ ময়ূর মায়ানমার থেকে জাভা পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতের প্রায় সব অংশে ময়ূরের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে সবুজ ও নীল ময়ূরের পাশাপাশি সাদা ময়ূরও দেখা যায়। এদের দেহ সাদা ও চোখ নীল। প্রকৃতপক্ষে নীল ময়ূরই জিনগত মিউটেশনের কারণে সাদা বর্ণ ধারণ করে। তবে ভারতীয় ময়ূরের মত সাদা ময়ূরের পেখমে সোনালী পালক বা নীল রংয়ের বড় ফোঁটা নেই। সাদা ময়ূর সম্পূর্ণ সাদা।
১৯৬৩ সালে ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষণা করা হয়, কারণ এটি সামগ্রিকরূপে ভারতের প্রচলিত রীতিনীতি ও সংস্কৃতির এক অংশ ছিল। ময়ূর হল লাবণ্য ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক। ময়ূরকে জাতীয় পাখি রূপে মনোনীত করার আরেকটি কারণ হল সারা দেশ জুড়ে তার উপস্থিতি। এমনকি সাধারণ মানুষও পাখির সঙ্গে খুব বেশিই পরিচিত। তাছাড়াও, এখনও পর্যন্ত আর অন্য কোনও দেশে তাদের জাতীয় পাখি হিসাবে ময়ূর ছিল না। ময়ূর এই সমস্ত কিছুকে পরিপূর্ণ করেছে, অতঃপর ভারতের জাতীয় পাখি হয়ে উঠেছে।
ময়ূরের পালককে অনেকেই মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ভেবে থাকে। সে জন্যই যে কোনো শুভ কাজে বা মঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ময়ূরের পালক ব্যবহার করা হয়। ময়ূরকে ধন-সম্পদের প্রতীক হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। আর এই কারণেই বাড়িতে ধন-সম্পদের বৃদ্ধি করতে অনেকে বাড়িতে ময়ূরের পালক রাখেন। ময়ূরের পেখম নিয়েও বিভিন্ন কাহিনী শোনা যায়। পুরাণ ঘাঁটলে একাধিক পশু পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। বা ধরুন মহাভারত বা রামায়নের মতো একাধিক জায়গায় একাধিক পশু পাখির উল্লখ পাওয়া যায়। ময়ূর সেভাবে এখন দেখা না মিললেও একরকম ভাবে একে প্রেমের প্রতিক মানা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণের মুকুটে ময়ূরের পালক লক্ষ্য করা যায়। ময়ূর হল লাবণ্য ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক হলেও বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।
ঐতিহাসিকভাবে প্রজাতিটি মায়ানমারের জাতীয় প্রতীক এবং 1963 সালে ময়ূর, ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষিত হলেও ময়ূর সংরক্ষণের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ময়ূরের পালক বিক্রি করে অর্থ উপার্জনের জন্য ময়ূর হত্যা ও চোরাশিকারিদের কারণে এদের সংখ্যা উদ্বেজনক ভাবে কমছে। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে এদের দেখা মিললেও বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। পূর্বে বাংলাদেশে এরা বিস্তৃত থাকলেও এখন তা সম্ভবত বিলুপ্ত। বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে বিশ্বব্যাপী এই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে এরা বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত।
তথ্যসূত্র:
1) https://bn.vikaspedia.in
2) https://www.onlineshikkhasite.com
3) https://bn.quora.com
4) www.wikipedia.org
5) https://flimandsports.com
লেখক:
অয়ন বিশ্বাস
ঘোড়ালিয়া,শান্তিপুর,নদিয়া।
No comments:
Post a Comment