গঙ্গা নদীর শুশুক (Ganges River Dolphin) শান্ত, নিরীহ জলজ প্রাণী। এই শুশুক প্রজাতি প্রাথমিকভাবে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী ও বাংলাদেশ ও নেপালে প্রবাহিত তাদের শাখানদীগুলোতে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ত দেখা যায়। স্বাদু জলের শুশুক ডলফিনের একটি প্রজাতি। শুশুক ডলফিন ও তিমির নিকট জ্ঞাতি, একান্তভাবে সামুদ্রিক কয়েকটি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্রকৃতপক্ষে এগুলি Cetacea বর্গের Phoeconidae গোত্রের অন্তর্গত ছোট দাঁতের তিমি। এদের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল ‘প্লাটানিস্টা গ্যাঞ্জেটিকা’ (দক্ষিণ এশীয় রিভার ডলফিন)। জাতীয় জলজ প্রাণীর তকমা মিলেছে। ঢুকে পড়েছে বিপন্নের তালিকায়।
বাদামি বা কালো বর্ণের এই প্রাণীটি অবাধে মিঠে জলে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় অন্ধ শুশুক পুরুষদের দৈর্ঘ্য দুই থেকে আড়াই মিটার এবং স্ত্রীদের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই মিটার। মাংশাসী প্রাণীটি খাবার হিসেবে মাছ এবং অন্য ছোট জলজ প্রাণীদের ভক্ষণ করে। প্রাণীটির নাসারন্ধ্রে একটি নরম মাংসপিণ্ড রয়েছে, এর নাম ‘বার্সা’; এর সাহায্যে এরা শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। এদের ঘ্রাণশক্তি তীব্র। এদের পুরো দেহ চর্বির আস্তরণে আবৃত, এই আস্তরণ ‘ব্লাবার’ নামে পরিচিত। এর কাজ হল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করা ও দেহকে গরম রাখা। শুশুকের মুখের সামনে রয়েছে একটি লম্বা ‘রস্ট্রাম’ যা তারা ‘ইকো-লোকেশন’-এর কাজে লাগায় ও শিকার ধরে। প্রাণীটির চোয়ালে রয়েচে ২৭ থেকে বত্রিশটি ছোট ছোট দাঁত যা আত্মরক্ষা, শিকার ধরার কাজে লাগে। শুশুকের শরীর মাথা থেকে লেজের দিকে ক্রমশ সরু, মজবুত অগ্রপদ ফ্লিপারে (Flipper) রূপান্তরিত হয়েছে, লেজের পাতাগুলি আনুভূমিক। দেহের মধ্যভাগে অবস্থিত সুবিকশিত পৃষ্ঠপাখনা (ব্যতিক্রম পাখনাহীন শুশুক Neophocaena phoeaenoides)। সব জাতের শুশুকই ঠোঁটবিহীন ও দুই চোয়ালেই একই রকম চেপ্টা চামচের মতো দাঁত। এদের পশ্চাৎপদ নেই, দেহ সম্পূর্ণ লোমহীন। দুটি নাসারন্ধ্র মিলে একটি নাসিকাগহবর গঠিত হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে সরাসরি জলের উপরের বাতাস ব্যবহার করে। এরা যখন ভেসে ওঠে তখন বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে ও শ্বাস নেয়।
শুশুকদের প্রধান খাদ্য মাছ। শিকারের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য এরা অতিদ্রুতগামী শব্দ সংকেত ব্যবহার করে। এদের তৈরি শব্দ লক্ষ্যবস্ত্তকে আঘাত করলে তার প্রতিধ্বনি দ্রুত শুশুকের কাছে ফিরে আসে। এ থেকে শুশুক তাৎক্ষণিকভাবে শিকারের আকার, দূরত্ব গতিবিধি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। এরা সমাজবদ্ধ প্রাণী, প্রায়ই দলবেঁধে চলাচল করে এবং শব্দ সংকেতের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
পুরুষ এবং স্ত্রী শুশুক একসঙ্গে থাকতে পছন্দ করে এবং কখনওই এরা একা থাকে না। কিন্তু বর্তমানে গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় এদেরকে একা একা ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টি পশুপ্রেমীদের কাছে এক অশনিসঙ্কেত বহন করে আনছে। প্রায় এক বছর গর্ভধারণের পর শুশুক একটি সন্তান প্রসব করে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে, তাদের জন্মহারের থেকে গত কয়েক দশকে মৃত্যুহার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। গঙ্গার শুশুকদের বাৎসরিক মৃত্যুহার ১৫০ থেকে ১৬০।
গাঙ্গেয় শুশুক তথা ডলফিন জাতীয় জলজ প্রাণীর মর্যাদা পেয়েছে ২০১০ সালে। কিন্তু জাতীয় জলজ প্রাণীর হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরে এদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংখ্যা নিয়মিত। জাতীয় জলজ প্রাণীর তকমা মিলেছে, কিন্তু আজ তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ঢুকে পড়েছে বিপন্নের তালিকায়। একটা সময় দেখা যেত, গঙ্গার বুকে মাঝেমধ্যেই ভেসে উঠত শুশুক। আবার পরক্ষণেই জলে ডুব দিত। এই সুন্দর দৃশ্য একটা সময় শিশুরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত।
‘ওরা বসত করে ক’জনা’, তা রাজ্যের বন দফতরের অজানা। ‘ওরা’ গাঙ্গেয় ডলফিন, চলতি কথায় শুশুক। জলের দূষণ, জেলের জাল, নদীর বাঁধ ও মানুষের অত্যাচারে এই নিরীহ প্রাণীগুলো লুপ্ত হওয়ার পথে। শুশুক বাঁচাতে বহু দিন ধরে আন্দোলন করছে দেশের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, গত কয়েক দশকে গঙ্গায় শুশুকের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। আইইউসিএন-এর ‘রেড ডেটা বুক’ অনুসারে আজ তারা বিপন্নের তালিকাভুক্ত। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ বা ডব্লিউ ডব্লিউ এফ-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গঙ্গায় চরম দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য শিকারের কারণে এদের সংখ্যা অত্যন্ত কমে গিয়েছে। চোরাশিকারিদের অবাধ বিচরণ এবং যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত বাঁধ তৈরির কারণে এদের সংখ্যা উদ্বেজনক ভাবে কমছে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া এবং বংশবৃদ্ধি।
সাম্প্রতিক সমীক্ষায় আরও জানা যাচ্ছে, বিহার সরকারের অনুদানে ‘জ়ুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’, ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া’ এবং ভাগলপুরের টিলকামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে হাজার কিলোমিটার অঞ্চল বরাবর গঙ্গার শুশুকদের উপরে সমীক্ষা চালানো হয়। এতে প্রায় ১,১৫টি০ শুশুকের সন্ধান মিলেছে। ২০০৫ সালে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬০০। অথচ ১৯৮২ সালের গণনা অনুসারে দেখা যাচ্ছে এই সময়কালে তাদের সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। গত শতকের এক সময়ে এই সংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো। এদের সংখ্যা হ্রাসের কারণে জলজ বাস্তুতন্ত্রে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বে গাঙ্গেয় শুশুকের সংখ্যা মেরেকেটে ১,২০০ থেকে ১,৮০০। ২০১৭ সালে হুগলি নদীতে এই প্রজাতির শুশুকের সংখ্যা চিহ্নিত করে তাদের অস্তিত্ব সংকট সম্পর্কে সবিস্তারে রিপোর্ট দিয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড-এর (WWF) গবেষক দল। নদীর দূষিত জলে তাদের টিকে থাকার লড়াই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন পরিবেশবিদরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তাদের সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্টই কাজ করেছে। শুশুকদের উপরে সর্বক্ষণ নজরদারির জন্য গঙ্গার ফরাক্কা থেকে ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এটি হয়েছে রাজ্য সরকার ও ডব্লিউডব্লিউএফ-এর উদ্যোগে। প্রথম ভাগে রয়েছে ফরাক্কা ও ফিডার ক্যানাল, দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে বেলুড় মঠ, বর্ধমান এবং নবদ্বীপ লাগোয়া গঙ্গার অংশ। তৃতীয় ভাগে রয়েছে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, এবং চতুর্থ ভাগে রয়েছে কোলাঘাট অঞ্চল। পঞ্চম ভাগে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার ও তার লাগোয়া এলাকা। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী, মৎস্যজীবী ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে শুশুকদের সংরক্ষণের কাজে, তা না হলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে গঙ্গার বুকে ভয়াবহ কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে। রাজ্য বনদপ্তরের উদ্যোগে ভাগীরথী ও অজয নদের সংযোগস্থলে রাজ্যের প্রথম গাঙ্গেয় শুশুক সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হল পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায।
কেন্দ্র গাঙ্গেয় শুশুক ও সামুদ্রিক ডলফিন, উভয় প্রাণীকেই সংরক্ষণ করবে। ‘প্রোজেক্ট ডলফিন’ একটি বহুমুখী প্রকল্প। এতে শুধু সংরক্ষণ নয় নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও পর্যটন ক্ষেত্র তৈরির সম্ভাবনাও বাড়ার আশা।
Wikipedia, প্রথম আলো, Hindustan Times Bangla, এইসময়, Banglapedia, আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments:
Post a Comment