বিশ্ব পরিবেশ দিবস (সংক্ষেপে WED) প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে পালিত দিবস। এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স (United Nations Conference on the Human Environment) শুরু হয়েছিল। এই কনফারেন্স হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি। এই কনফারেন্স ঐ বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। তখন থেকেই প্রতি বৎসর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। প্রতি বছরই দিবসটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পালিত হয়। উত্তর গোলার্ধে দিবসটি বসন্তে, আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি শরতে পালিত হয়।১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৪ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ ই জুনকে জাতিসংঘ 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
বন উজাড়, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা, খাদ্যের অপচয় ও ক্ষতি, দূষণ ইত্যাদির মতো পরিবেশগত সমস্যা মোকাবেলা করা প্রয়োজন। সারা বিশ্বে কার্যকারিতা আনতে একটি নির্দিষ্ট থিম এবং স্লোগান নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রচারণার আয়োজন করা হয়।
এই দিনটি সফলভাবে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন, গ্রিনহাউস প্রভাব হ্রাস, বন ব্যবস্থাপনা, অবক্ষয়িত জমিতে রোপণ, সৌর উত্সের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন, প্রবাল প্রাচীর এবং ম্যানগ্রোভের উন্নয়ন, নতুন নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য পালিত হয়।
মহাবিশ্বে লাখো কোটি নক্ষত্রের মধ্যে আমাদের বাড়ি ‘সৌরজগতে’, অর্থাৎ সূর্য নামক নক্ষত্রটিকে ঘিরে যে গ্রহগুলো ঘুরছে, তাদেরই একটি হচ্ছে আমাদের এই ‘পৃথিবী’। তবে এখন পর্যন্ত ‘পৃথিবী’ ছাড়া আর কোনো গ্রহই প্রাণী বসবাসের উপযোগী নয়। তাপমাত্রা বিবেচনা করলেও এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রতীয়মান। সূর্যের দিক থেকে কাছাকাছি দূরত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর আগের গ্রহটি হচ্ছে শুক্র, আর পরবর্তী গ্রহটি হচ্ছে মঙ্গল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই তিনটি গ্রহের তাপমাত্রা যথাক্রমে শুক্র (প্রায় ৫০০ ডিগ্রি সে.), পৃথিবী (প্রায় ১৫ ডিগ্রি সে.) আর মঙ্গল (প্রায় মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সে.)। সূর্য থেকে দূরত্ব বিবেচনায় এভাবে আর সব কটি গ্রহের তাপমাত্রাই যথাক্রমে বাড়তে অথবা কমতে থাকে, যার মানে হচ্ছে এই যে সৌরজগতে শুধু পৃথিবীর তাপমাত্রাই কেবল প্রাণী বসবাসের যোগ্য, আর কোনোটি নয়। প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় আর সব উপাদানও নেই আর কোনো গ্রহে।
কিন্তু তারপরও ‘একটি মাত্র পৃথিবী’ আর এই একই পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা সবাই, এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বরাবরই আমাদের অনেক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে গেলে, এক গাঁয়ের মানুষকে আপন মনে হয়, দূর প্রবাসে নিজ দেশের যে কাউকে আপন মনে হয়, একইভাবে সে যে গ্রাম, উপজেলা বা জেলারই হোক না কেন। কিন্তু এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে আমাদের যাতায়াত নেই বিধায় এ সুযোগ আমাদের কখনোই হয়ে ওঠেনি সেই হিসাবে যে আমরা একই গ্রহের বাসিন্দা, যার নাম ‘পৃথিবী’।
আবার এই একই পৃথিবীতে আমাদের পরস্পরের মাঝে যোগসূত্রও একই সুতায় বাঁধা। পরিবেশবিজ্ঞানে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও বিভিন্ন তত্ত্ব আর সূত্রের অবতারণা করা হয়েছে। ‘এনভায়রনমেন্টাল ইউনিটি’ ধারণাটিতে বলা হয়েছে, সমগ্র পৃথিবী একটি ‘কন্টিনিউয়াম’ বা একক সত্তা।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের কারণে মানুষের জীবন বিদ্যমান। পরিবেশ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বাতাস থেকে শুরু করে খাদ্য এবং পানীয় সবকিছু সরবরাহ করে এবং পৃথিবীতে বসবাসের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ দেয়। এ সবই প্রকৃতির দান। প্রকৃতি ও পরিবেশের কারণেই মহাবিশ্ব সুচারুভাবে চলে। প্রকৃতি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু দেয় কিন্তু বিনিময়ে মানুষ কেবল প্রকৃতিকে শোষণ করেছে এবং পরিবেশকে দূষিত করেছে। এতে প্রকৃতির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি প্রাণের অস্তিত্বও হুমকির মুখে। এমতাবস্থায় পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। বিশ্ব উষ্ণায়ন, সামুদ্রিক দূষণ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ করুন, যাতে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, প্রকৃতি রক্ষার জন্য ৫ টি সংকল্প নিন, যাতে পরিবেশ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
সংকল্প ১:
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রথম সংকল্প নিন যে আমরা ঘর থেকে উৎপন্ন বর্জ্য সঠিক স্থানে নিয়ে যাব। প্রতিদিন আমাদের বাড়ি থেকে প্রচুর আবর্জনা বের হয়। যা মানুষ এখানে-ওখানে ফেলে দেয়। এই বর্জ্য হয় পশুর পেটে যায় অথবা নদীতে ভেসে যায়। এ কারণে আমাদের নদীগুলোও দূষিত হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা এখানে-ওখানে না ফেলে নিজেই ডাস্টবিনে ফেলুন। শুকনো ও ভেজা বর্জ্য আলাদা করে ফেলুন যাতে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়।
সংকল্প ২:
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির জীবন চলে এবং শ্বাস নিতে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রয়োজন হয়। তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শপথ নিন যে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস থাকবে, এর জন্য আমরা পেট্রোল-ডিজেলের পরিবর্তে ই-বাহন ব্যবহার করব। ব্য়ক্তিগত গাড়ির পরিবর্কে বেশি গণপরিবহন ব্যবহার করবেন।
সংকল্প ৩:
গাছ-গাছালির উপর নির্ভরশীল প্রকৃতি। কিন্তু আজকাল নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। গাছ কাটার কারণে অক্সিজেনের অভাবের পাশাপাশি আবহাওয়া চক্রেরও অবনতি ঘটছে। এ কারণে অনেক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হতে পারে। এমতাবস্থায় অঙ্গীকার নিন যে, গাছ কাটা বন্ধ করে আমরা আরও বেশি করে চারা রোপণ করব, যাতে এ পর্যন্ত প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়া যায়।
সংকল্প ৪:
গাছ-পালা, মাটি, মাটি, প্রাণী, জল ইত্যাদি পরিবেশকে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রার্থনা করুন পরিবেশের ভারসাম্য যেন সবসময় বজায় থাকে এবং পরিবেশের ভারসাম্য ও নিরাপদ রাখতে যা যা করা দরকার তাই করবেন।
সংকল্প ৫:
পরিবেশ দিবসে পঞ্চম এবং শেষ সংকল্প নিন যে আমরা পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করব। প্রকৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু পলিথিন ও প্লাস্টিক। এমতাবস্থায় আপনি নিজে যেমন এগুলো ব্যবহার করবেন না, তেমনি অন্য কাউকে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করতে দেখলে তাকেও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করবেন।
তথ্যসূত্র:
১) Wikipedia
২) কালিকলম
৩) আজতক বাংলা
৪) প্রথম আলো
লেখক:
বি.এসসি, এম.এ(ভূগোল), বি. এড্
ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদিয়া।
No comments:
Post a Comment