ভোজনপ্রিয় বাঙালিদের বারো মাসে তের পার্বণ। যে কোনও উৎসব, আনন্দ-উদযাপনের একটা 'কমন ফ্যাক্টর' হল খাওয়া - দাওয়া। সেরকমই প্রতিটা পুজো -পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হরেক রকম পদ। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বসন্ত পঞ্চমী (Vasant Panchami) বা সরস্বতী পুজো (Saraswati Puja) হয়। এদিন বহু বাঙালি বাড়িতে নিয়ম আছে জোড়া ইলিস বরণ (Jora Ilish Boron)। অনেকেই সারা বছর মুখিয়ে থাকেন সরস্বতী পুজোর দিন ইলিশ মাছ ( Hilsa Fish) খাওয়ার জন্য। হিন্দু ধর্মে, জোড়া ইলিশ কেনা খুব শুভ বলে মনে করা হয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রীতি। তবে এই রীতি, পশ্চিমবাংলার আদি বাসিন্দারা অর্থাৎ এদেশীয়রা পালন করেন না। এটি পূর্ববঙ্গীয়দের রীতি। শোনা যায়, জোড়া ইলিশ মাছ বরণ পূর্ববঙ্গের দক্ষিণের জেলাগুলিতেই বেশি প্রচলিত ছিল। তার মধ্যে বিক্রমপুর অঞ্চলেই এই প্রথার উদ্ভব বলে মনে করা হয়।
এটি মূলত পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি সরস্বতী পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। এই পদটি মূলত শ্রীপঞ্চমীর দিনে খাওয়ার রেওয়াজ। ওই একই দিনে সরস্বতী পুজো হয় বলে একই দিনে দু’টি পালিত হয়।
সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ মাছ বরণ পূর্ববঙ্গীয়দের এক অন্যতম লোকাচার। কিছু বাড়িতে আবার এদিন, ইলিশ মাছের বিয়ে দেওয়ার রীতি আছে। যদিও মনে করা হয়, সরস্বতী পুজোর সঙ্গে এই রীতির সরাসরি কোনও যোগ নেই। তবে একই চান্দ্র তিথিতে হয়, দুই অনুষ্ঠান। বসন্ত পঞ্চমীর দিন সকালে কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ইলিশ কিনতে যেতেন। এরপর ধান, দূর্বা, তেল, সিঁদুর ও কাঁচা হলুদ সহযোগে মাছটি উলু ও শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে, কুলোর উপর সাজিয়ে রাখা হয়।
কিছু পরিবারে, জোড়া ইলিশ মাছ বরণের সময়, দুটি গোটা বেগুন ও লাউ ডগাও রাখা হয়। অনেক পরিবারের নিয়ম, দুটির জায়গায় একটি ইলিশ মাছা বরণ করা। সেখানে ইলিশের সঙ্গে নোড়া রাখা হয়, যাকে নোড়া দিয়ে জোড়া বা ইলশার বিয়ে বলে। নোড়াটি পুরুষ এবং মাছটিকে নারীর রূপে ধরা হয় এবং উলু- শঙ্খ ধ্বনি, ধান- দূর্বা, তেল, সিঁদুর, কাঁচা হলুদ দেওয়া হয় তখন।
বহু পরিবারে জোড়া ইলিশ বরণের সময় মুখে টাকা গুঁজে দেওয়া হয়। যিনি মাছ কাটবেন, সাধারণত এই টাকাটি তার প্রাপ্য। তবে মাছা কাটার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ নিয়ম। আঁশ এদিক ওদিক যাতে ছড়িয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কলাপাতার উপর রেখে অনেকে আঁশ ছাড়ান। পরে সেটি মুড়ে যে কোনও পরিষ্কার স্থানে তা পুঁতে দিতে হয়।
কেন সরস্বতী পুজোয় এই নিয়ম? (Saraswati Puja Rituals)
এই নিয়ে নানা মতভেদ আছে। তবে মনে করা হয়, পূর্ববঙ্গের মৎসজীবি সম্প্রদায়রা এক সময়, বিজয়া দশমীর পর আর ইলিশ মাছ ধরতেন না। বসন্ত পঞ্চমীর সময় থেকে আবার মাছ ধরতেন তারা। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ সময় থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কালে অপরিণত ইলিশ ধরা পড়ে। আসলে এটাই শিশু ইলিশদের সমুদ্রে ফেরার সময়। শোনা যায়, বহু যুগ আগে পূর্ব বাংলার মৎসজীবিরা এদিন বিশেষ মঙ্গলাচরণের মধ্যে দিয়ে ইলিশ ধরার সূচনা করতেন।
আবার লোক মুখে শোনা যায়, ব্রাক্ষণরা আগে কট্টর নিরামিষাশী থাকার ফলে মাছ খেতেন না। এরপর ধীরে ধীরে প্রচলন হল শাস্ত্রে বলা আছে যে, মাছেরা আসলে সমুদ্রের ফল বা জল তরু তাই অনায়াসে মাছকে শাক সব্জির মধ্যে ফেলা যায়।
এই ইলিশ রান্নার বিশেষ পদ্ধতিও আছে। কীভাবে রান্না হয় সরস্বতী পুজোর ইলিশ? জোড়া ইলিশ বরণ করার পর এই মাছ রান্নার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ রীতি। এক ফোড়ন দিয়ে এই রান্না হয়। অর্থাত্ ফোঁড়ন এবং সমস্ত তরকারি একসঙ্গেই দিতে হয় কড়াইতে। তার পরে জল দিতে হয়। হলুদ বাটার ঝোল ফুটে উঠলে মাছগুলি কাঁচা অবস্থায়ই ঝোলে দিতে হয়।এই রান্নায় কোনও গুঁড়ো মশলা যেমন গুঁড়ো হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, ইত্যাদি ব্যবহার করার নিয়ম নেই। কাঁচা হলুদ এবং কাঁচা লঙ্কা ব্যবহার করে এই পদ রান্না করা হয়।
বর্তমানে উৎসবের এই মেজাজ ও রীতিনীতি অনেকটা শিথিল হয়েছে কর্ম ব্যস্ততার জন্য। তবে শহরে কম হলেও, গ্রামাঞ্চল বা শহরতলিতে এখনও এই পার্বণ ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়। সরস্বতী পুজোয় অনেকেই বাড়িতেই জোড়া ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে এখনও।
No comments:
Post a Comment