পৃথিবীতে মানুষের বসবাস প্রায় ৩০ লাখ বছর। অথচ সেই তুলনায় আমাদের মাতৃগ্রহের বয়স নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু মাত্র সেদিন বলা যায়। মাত্র ৩০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তবে পৃথিবীর সঠিক বয়স সম্পর্কে জানা গেছে এই সেদিন। প্রশ্ন হল, পৃথিবীর এই বয়স নির্ধারিত হলো কীভাবে? আর তা নির্ধারণে আমাদের এত সময়ই বা লাগল কেন? কোনো মানুষ বা প্রাণীর বয়স নির্ধারণের জন্য তার জন্মসাল জানার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পৃথিবীর জন্মের সময় তো কোনো মানুষই ছিল না। তাহলে কীভাবে সম্ভব হল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে তিন শতাব্দী পেছনের কথা জানতে হবে। ১৭ শতকে ইউরোপের অন্যতম পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন আর্চবিশপ জেমস উশার। সেকালে বাইবেল ঘেঁটে তিনি দাবি করেন, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৩ অক্টোবর, শনিবার। পৃথিবীর এই জন্মতারিখ নির্ধারণ করে তিনি বেশ আলোচিত-সমালোচিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দাবি মেনে নেননি বিজ্ঞানীরা।
দিন যতই গড়াতে লাগল, ততই ভূতাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন বিষয় বুঝতে শুরু করলেন। তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন, জেমস উশারের কথামতো পৃথিবীর বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর হতে পারে না। কাজেই বয়স নির্ধারণে তাঁরা নতুন পদ্ধতির খোঁজ চালালেন। এসবের মধ্যে আছে পৃথিবী বা সূর্য বর্তমান তাপমাত্রায় এসে পৌঁছাতে কত সময় লেগেছে তা নির্ণয় করে, সমুদ্র স্তরের পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে এবং সাগরের লবণাক্ততার পরিমাণ পরীক্ষা করে। কিন্তু সব পদ্ধতিই একসময় অনির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। যেমন ফরাসি বিজ্ঞানী জর্জ লুই লেক্লিয়ার্ক দ্য বাফনের পদ্ধতির কথাটা বলা যাক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সূর্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতি উত্তপ্ত কোনো বস্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। লোহার গোলক আর বিভিন্ন আকারের পাথর নিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর আরও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান বাফন। ১৭৭৫ সালে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। তাঁর হিসাবে দেখা গেল, জন্মের পর থেকে পৃথিবী বর্তমানের তাপমাত্রায় আসতে প্রায় ৭৪ হাজার ৮৩২ বছর লাগা উচিত। কিন্তু এই ফলাফল অনেকেই মেনে নিতে পারল না।
পরের শতকে আরও কিছু পরীক্ষা চালান বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে ছিল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া শুরু হতে কতটা সময় দরকার, তা নিয়ে গবেষণা। এভাবে ১৯ শতকে কোনো কিছুর বয়স নির্ধারণে দুটি পদ্ধতির জন্ম হল। এর মধ্যে প্রথমটি হল, পাথরের মোট ঘনত্ব হিসাব করা এবং কী হারে পলি জমেছে, তা হিসাব করা। এভাবে পৃথিবীর পাথরগুলো জমে উঠতে কতটা সময় লেগেছে, তা–ও নির্ণয় করা হল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন জায়গায় পাথর জমার হার পাওয়া গেল বিভিন্ন রকম। তাই এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর বয়স নির্ণয়েও বড় ধরনের পার্থক্য পাওয়া গেল। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা গেল, পাথরগুলোর বয়স ৩ থেকে ২৪০০ মিলিয়ন বছরের যেকোনোটা হতে পারে। এর সরল মানে হল, পৃথিবীর এক পাশের বয়স হয়তো পাওয়া গেল ৩ বছর, আর আরেক পাশের বয়স পাওয়া গেল ২৪০০ মিলিয়ন বছর। কিন্তু তা কি সম্ভব? একই পৃথিবীর দুই জায়গার বয়স দুই রকম হবে কেন? কাজেই এ পদ্ধতিতে আসলে কাজের কাজ কিছু হলো না। পৃথিবীর বয়সটা আগের মতোই অজানা থেকে গেল। বয়স নির্ণয়ের দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ছিল সাগরে লবণ জমা হওয়ার হার নির্ধারণ করা। নদীর জলেতে দ্রবীভূত লবণ থাকে। পাথরের ওপর দিয়ে জল প্রবাহিত হওয়ার সময় পাথর ক্ষয়ের মাধ্যমে এই লবণ আসে। এভাবে নদীর জলেতে দ্রবীভূত লবণ ধীরে ধীরে সাগরে গিয়ে জমা হয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান, শুরুতে সাগরের জল বিশুদ্ধ ছিল, তাতে এখনকার মতো লবণ ছিল না। পাথর ক্ষয় থেকে আসা লবণ ধীরে ধীরে জমে সাগরের জল বর্তমান লবণাক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং কোনোভাবে যদি জানা যায় সাগরে কী হারে লবণ জমা হয়েছে, তাহলে পৃথিবীর বয়সও জানা যাবে। কিন্তু বয়স নির্ধারণের এই পদ্ধতিও বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়ে। সে কারণে প্রথম পদ্ধতির মতো এভাবে নির্ধারিত বয়সেরও হেরফের পাওয়া যেতে লাগল। কাজেই দ্বিতীয় পদ্ধতিটিও শেষ পর্যন্ত গ্রহণীয় হল না। বাতিলের খাতায় নাম ওঠাল এটাও।
এরপর মঞ্চে আসেন বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন (আসল নাম উইলিয়াম থমসন)। ১৮৬২ সালে তিনি যুক্তি দেখান, একসময় পৃথিবী আসলে গলিত অবস্থায় ছিল। সুতরাং কত তাপমাত্রায় পাথর গলে যায় এবং কী হারে তা ঠান্ডা হয়, তা জানা গেলে পৃথিবীর ভূত্বক জমাট বেঁধে শক্ত হতে কত সময় লেগেছে, সেটি নির্ণয় করা সম্ভব। এভাবে কেলভিনের হিসাবে পৃথিবীর বয়স হওয়ার কথা ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর। তবে এই ফলাফল নিয়ে সেকালে বেশ শোরগোল করে ওঠেন ভূতাত্ত্বিকেরা। উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকে নতুন কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সেটা ছিল রোমাঞ্চকর এক দশক। ১৮৯৫ সালের দিকে রহস্যময় এক রশ্মি আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিলেন উইলিয়াম রন্টজেন। ভুতুড়ে ও অজানা এই রশ্মির নাম দিলেন এক্স-রে। তার পরের বছর দেখা গেল, ইউরেনিয়াম পরমাণু থেকেও প্রায় একই রকম রহস্যময় রশ্মি নির্গত হয়। পদার্থবিদ মেরি কুরি যার নাম দেন রেডিওঅ্যাকটিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। ১৮৯৭ সালে জে জে থমসন ইলেকট্রন নামের একটি কণা আবিষ্কার করে বসেন। অন্যদিকে ১৯০২ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ফ্রেডরিক সোডি আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। অবাক হয়ে তাঁরা দেখেন, তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে একটি মৌল আরেকটি মৌলে পরিণত হয়। যেমন ইউরেনিয়াম ক্ষয় হয়ে রূপান্তরিত হয় রেডিয়ামে। আবার এই রেডিয়াম মৌল ক্ষয় হয়ে রেডন গ্যাসে পরিণত হয়। কিছুদিন পর সোডি প্রমাণ করে দেখান যে এই ক্ষয় প্রক্রিয়ায় শুধু রেডন গ্যাসই নয়, তার সঙ্গে হিলিয়াম গ্যাসও থাকে। আবার খোদ রেডনই শেষ কথা নয়। রেডন অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে অন্যান্য কিছু মৌলে পরিণত হয়। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে যে হিলিয়াম তৈরি হয়, এই আবিষ্কারটা পৃথিবীর বয়স নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে হিলিয়াম গ্যাস শনাক্ত করার পর কিছু ব্যাপার বেশ সহজ হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড বুঝতে পারলেন, হিলিয়াম উৎপাদনের হার যদি কোনোভাবে জানা যায়, তাহলে তুলনামূলক সহজ গণনার মাধ্যমে নির্ণয় করা যাবে যে ওই হিলিয়াম জমতে কতটা সময় লেগেছে। আর একই সঙ্গে তার মাধ্যমেই জানা যাবে পাথর তথা পৃথিবীর বয়সও। এক বছর পর রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় ক্ষয়পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমবার একটি পাথরের বয়স নির্ণয় করেন। এভাবে তিনি পাথরটির বয়স পান ৪০ মিলিয়ন বছর।
দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁর পদ্ধতিতে বেশ বড় ধরনের একটা ত্রুটি ছিল। এই ত্রুটিটি অন্য কারও চোখে না পড়লেও লন্ডনের রয়্যাল কলেজের লেকচারার রবার্ট স্টুয়ার্টের চোখ এড়ায়নি। তিনি বলেন, হিলিয়াম গ্যাস হওয়ার কারণে তা পাথর থেকে চলে যাবে। তাই এটি আমলে না নিলে রাদারফোর্ডের পদ্ধতিতে পাথরের সঠিক বয়স নির্ণয় করা যাবে না। ১৯০৭ সালে মার্কিন রসায়নবিদ বারট্রাম বোল্টউড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পাথর বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে সেখানে সিসা পাওয়া যাচ্ছে, যার পরিমাণ মন্দ নয়। এটি দেখে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে চূড়ান্ত ধাপ হলো লেড বা সিসা। এভাবে পাথরের বয়স নির্ধারণে অনেক দিন পর একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির দেখা পাওয়া গেল। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ কিছু পাথরের বয়স নির্ধারণ করা হলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরোনো পাথরের বয়স পাওয়া গেল ১৬৪০ মিলিয়ন বছর। এর মানে দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে ১৬৪০ মিলিয়ন বছর। তবে ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক সোডির আইসোটোপ আবিষ্কারের পর পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে উঠল। আবার এদিকে আর্থার হোমস নামের এক বিজ্ঞানী যুক্তি দিলেন, পৃথিবীতে কিছু সিসা পাওয়া যায়, যেগুলো সম্ভবত পৃথিবী গঠিত হওয়ার পর থেকেই এখানে আছে। এদের বলা হয় আদিম সিসা। কিন্তু তিনি কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারলেন না, কোন সিসাটা তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ক্ষয়ের মাধ্যমে এসেছে আর কোন সিসাটা আদিম। কাজেই পরিষ্কার বোঝা গেল, সিসার উৎপত্তি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা গেলে পাথর তথা পৃথিবীর বয়স নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল রয়ে যাবে।
১৯৩৮ সালে তরুণ মার্কিন পদার্থবিদ আলফ্রেড নিয়ার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ধরনের একটি ভর স্পেকট্রোমিটার নিয়ে কাজ করছিলেন। এটি দিয়ে সিসার (রাসায়নিক প্রতীক Pb) জানা আইসোটোপ শনাক্ত করতে চাচ্ছিলেন তিনি। প্রত্যাশামতোই তিনি বেশ দ্রুতই আমাদের জানা থাকা সিসার তিনটি আইসোটোপ খুঁজে পেলেন। সেগুলো হলো ২০৬Pb, ২০৭Pb ও ২০৮Pb। কিন্তু বর্ণালীর একেবারে শেষ প্রান্তে অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পেলেন তিনি। সেটি ভালোভাবে বিশ্লেষণের পর হাতে যেন চাঁদ পেলেন আলফ্রেড নিয়ার। তিনি নিশ্চতভাবে বুঝতে পারলেন, এটিই সেই আদিম সিসা বা ২০৪Pb। এভাবেই ইউরেনিয়াম-সিসা জিগস পাজলের হারিয়ে যাওয়া টুকরোর খোঁজ পাওয়া গেল। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরেক মার্কিন বিজ্ঞানী ক্ল্যারি প্যাটারসন পেলেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। তিনি এক উল্কাতে অতিক্ষুদ্র পরিমাণ সিসা শনাক্ত করতে পারেন। পরবর্তী তিন বছরে পৃথিবী, উল্কা ও অন্যান্য গ্রহের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে গবেষণা করেন তিনি। এই ফলাফল থেকে তিনি প্রমাণ দেখান, পৃথিবী, গ্রহাণু ও অন্য গ্রহগুলো একই উৎস থেকে এসেছে। আবার পৃথিবী থেকে পাওয়া নমুনা (পরে চাঁদ থেকে আনা নমুনা) এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তুলনা করে দেখা হয়। এতে প্রমাণ পাওয়া গেল যে পৃথিবী ও উল্কা একই সৌরজাগতিক উপাদান দিয়ে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল। এভাবেই অনেক প্রাচীন এক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল অবশেষে। এখন আমরা জানি, পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর (সঠিকভাবে বললে ৪.৫৪ বিলিয়ন), ১ শতাংশ কম-বেশি হতে পারে। ৬৩ বছর আগে পৃথিবীর এই বয়স নির্ধারণের পর তা খুব বেশি হেরফের হয়নি। এভাবে বিজ্ঞানীদের অনেক দিনের চেষ্টার পর অবশেষে পৃথিবীর বয়স নির্ধারিত হল।
সৌজন্যেঃ- প্রথম আলো