Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Saturday 27 August 2022

পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কিভাবে ? (Origin of life on Earth)

 বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে আমরা যেসব জীবের সঙ্গে পরিচিত, তাদের মধ্যে দশ লাখের বেশি প্রাণী প্রজাতি এবং চার লাখের মতো উদ্ভিদ-প্রজাতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।


Origin of life on Earth
পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি (Origin of life on Earth)

একসময় মানুষের ধারণা ছিল, পৃথিবী বুঝি অপরিবর্তিত, অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর যে আকার বা আয়তন ছিল, এখনো সেরকমই আছে। অর্থাৎ তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মানুষ ভাবতো আদি জীবজগতের সঙ্গে বর্তমানকালের জীবজগতের কোনো পার্থক্য নেই।

কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে জেনোফেন (Xenophane) নামের একজন বিজ্ঞানী প্রথম কতকগুলো জীবাশ্ম (fossil) আবিষ্কার করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, অতীত এবং বর্তমান যুগের জীবদেহের গঠনে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। অর্থাৎ জীবদেহের আকার অপরিবর্তনীয় নয়।

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle) প্রমাণ করেন যে জীবজগতের বিভিন্ন জীবের ভেতর এক শ্রেণির জীব অন্য শ্রেণির জীব থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নত এবং জীবগুলো তাদের পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে বিবর্তন বা অভিব্যক্তির মাধ্যমে ক্রমাগত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

বিবর্তন একটি মন্থর এবং চলমান প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠনগতভাবে সরল জীব থেকে জটিল জীবনের উৎপত্তি ঘটেছে।

বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতানুসারে, প্রায় সাড়ে চারশত কোটি বছর আগে এই পৃথিবী একটি উত্তপ্ত গ্যাস- পিণ্ড ছিল। এই উত্তপ্ত গ্যাস-পিণ্ড ক্রমাগত তাপ বিকিরণ করায় এবং তার উত্তাপ কমে যাওয়ায় ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে তরল অবস্থা প্রাপ্ত হয়। 

পরে এই পিণ্ডটি বাইরের দিক থেকে ভেতরের দিকে ক্রমশ কঠিন হতে থাকে এবং উদ্ভূত জলীয় বাষ্প থেকে মেঘের সৃষ্টি হয়। ওইরকম মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ায় পৃথিবীর কঠিন বহিঃস্তরে জলভাগ অর্থাৎ সমুদ্রের আবির্ভাব ঘটে। সমুদ্রের পানিতে সৃষ্ট জীবকুলের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে বর্তমানের বৈচিত্র্যময় জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে।

গভীর যুক্তিনির্ভর চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আধুনিক মানুষের ধারণা হয়েছে যে জীব সৃষ্টির মূলেই রয়েছে বিবর্তন। ল্যাটিন শব্দ ‘Evolveri’ থেকে বিবর্তন শব্দটি এসেছে। ইংরেজ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেনসার (Herbert Spencer) সর্বপ্রথম ইভোলিউশন কথাটি ব্যবহার করেন। 

যে ধীর, অবিরাম এবং চলমান পরিবর্তন দ্বারা কোনো সরলতর উদবংশীয় জীব পরিবর্তিত হয়ে জটিল ও উন্নততর নতুন প্রজাতির বা জীবের উদ্ভব ঘটে, তাকে বিবর্তন বা অভিব্যক্তি বা ইভোলিউশন বলে। 

সময়ের সাথে কোনো জীবের পরিবর্তনের ফলে যখন নতুন কোনো প্রজাতি সৃষ্টি হয়, তখন তাকে বলে জৈব বিবর্তন।

জীবনের আবির্ভাব কোথায়, কবে এবং কীভাবে ঘটেছে (Where, when and how did life begin?)

পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ বর্তমানে প্রচলিত আছে। তবে জীবনের উৎপত্তি যে প্রথমে সমুদ্রের পানিতে হয়েছিল এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই।








পৃথিবীতে জল কিভাবে এলো ?

 বিজ্ঞান জগতের বৈজ্ঞানিক বা গবেষকরা অনেক বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে। প্রতিদিন বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে থাকে এবং সেই আবিষ্কার গুলি হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। যেমন অনেক বছর ধরে গবেষকরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে যে পৃথিবীতে জল কিভাবে এলো ?



পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। ছোটবেলা থেকে এ কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু পৃথিবীতে এত জল এল কোথা থেকে! জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দাবি, পৃথিবীতে প্রথম জল বয়ে এনেছিল কোনও উল্কাই! যদিও, এই তত্ত্বটি প্রমাণ করা বেশ কঠিন। কারণ, এর আগে পর্যন্ত পৃথিবীতে পৌঁছানো উল্কাগুলিতে জলের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। তবে সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীতে আছড়ে পড়া উল্কাখণ্ডে জল প্রবাহের প্রমাণ অবাক করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।

সম্প্রতি Phys.org-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশ পৃথিবীতে প্রথম জল নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উল্কাখণ্ড বা উল্কাবৃষ্টির ভূমিকা থাকার বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছেন। সিডনির ম্যাককুয়েরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (Macquarie University) জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাইমন টার্নার ও তাঁর সহকারী বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর জানিয়েছেন, যেটুকু তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, কোনও এক বা একাধিক উল্কাই পৃথিবীতে জল এনেছিল। আজ থেকে প্রায় ৪৪০ কোটি বছর আগেই পৃথিবীতে জল এনেছিল এক বা একাধিক উল্কাখণ্ড।

গ্রহের জন্মলগ্নে এটি অসম্ভব রকমের গরম ছিল। জলে ভরা উল্কাখণ্ডগুলি প্রচণ্ড উত্তপ্ত পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। এর ফলে উল্কাখণ্ডগুলির ভেতরে থাকা জলের পুরোটাই বাষ্পীভূত হয়ে গিয়ে ঘন মেঘের বিশাল স্তরের সৃষ্টি করেছিল। ওই মেঘের কারণেই পৃথিবীতে প্রবল ঝড়, বৃষ্টি হয় এবং জলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এই গ্রহ।

কিন্তু কী ভাবে অত জল এল ওই উল্কাখণ্ডগুলিতে ?
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, ওই বিশেষ ধরনের উল্কাগুলিতে মিশে থাকা খনিজ আর জৈব পদার্থ থেকেই এই জলের জন্ম হয়েছিল। এই উল্কাগুলিতে থাকা প্রচুর জল আর জৈব যৌগগুলিতে ছিল অফুরন্ত হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ‘ডয়টেরিয়াম’, যাকে আমরা ‘ভারি জল’ বলে থাকি। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, পৃথিবীর তিন ভাগ জলে হাইড্রোজেন আর ডয়টেরিয়ামের অনুপাত যতটা, ওই উল্কাগুলিতেও এর অনুপাত ঠিক ততটাই।

বছর খানেক আগে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৪১০ কিলোমিটার থেকে ৬৬০ কিলোমিটার নীচে একটা সুবিশাল জলাধারের হদিশ পেয়েছেন মার্কিন ভূতাত্ত্বিকরা। এই নীল গ্রহের সমস্ত সমুদ্র, মহাসমুদ্র মিলিয়ে যে পরিমাণ জল রয়েছে, তার প্রায় তিন গুণ বেশি পরিমাণ জল রয়েছে ভূগর্ভস্ত প্রাকৃতিক জলাধারে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, রিংউডাইট (Ringwoodite) নামের এক বিশেষ ধরনের শিলার ভাঁজে প্রচণ্ড চাপে আটকে রয়েছে ওই বিপুল পরিমাণ জল। এই জল অবশ্য তরল অবস্থায় নেই, রয়েছে হাইড্রক্সিল আয়ন ও হাইড্রক্সাইড হিসেবে।

বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক গবেষণায় ধারণা হয়েছে, বেশির ভাগ না হলেও কার্বনাসিয়াস কনড্রাইট (সিসি) - কমপক্ষে ৮টি পরিচিত শ্রেণি এবং অনেক শ্রেণিহীন উল্কাখণ্ডের সমন্বয়ে বৃহত্তর গ্রহাণুর অংশ হিসাবে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে গঠিত হয়েছিল।

Friday 12 August 2022

পৃথিবীর বয়স কত?

পৃথিবীতে মানুষের বসবাস প্রায় ৩০ লাখ বছর। অথচ সেই তুলনায় আমাদের মাতৃগ্রহের বয়স নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু মাত্র সেদিন বলা যায়। মাত্র ৩০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে এর বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করেন। তবে পৃথিবীর সঠিক বয়স সম্পর্কে জানা গেছে এই সেদিন। প্রশ্ন হল, পৃথিবীর এই বয়স নির্ধারিত হলো কীভাবে? আর তা নির্ধারণে আমাদের এত সময়ই বা লাগল কেন? কোনো মানুষ বা প্রাণীর বয়স নির্ধারণের জন্য তার জন্মসাল জানার প্রয়োজন হয়। কিন্তু পৃথিবীর জন্মের সময় তো কোনো মানুষই ছিল না। তাহলে কীভাবে সম্ভব হল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে তিন শতাব্দী পেছনের কথা জানতে হবে। ১৭ শতকে ইউরোপের অন্যতম পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন আর্চবিশপ জেমস উশার। সেকালে বাইবেল ঘেঁটে তিনি দাবি করেন, পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালের ২৩ অক্টোবর, শনিবার। পৃথিবীর এই জন্মতারিখ নির্ধারণ করে তিনি বেশ আলোচিত-সমালোচিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দাবি মেনে নেননি বিজ্ঞানীরা।



দিন যতই গড়াতে লাগল, ততই ভূতাত্ত্বিকেরা বিভিন্ন বিষয় বুঝতে শুরু করলেন। তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন, জেমস উশারের কথামতো পৃথিবীর বয়স মাত্র কয়েক হাজার বছর হতে পারে না। কাজেই বয়স নির্ধারণে তাঁরা নতুন পদ্ধতির খোঁজ চালালেন। এসবের মধ্যে আছে পৃথিবী বা সূর্য বর্তমান তাপমাত্রায় এসে পৌঁছাতে কত সময় লেগেছে তা নির্ণয় করে, সমুদ্র স্তরের পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে এবং সাগরের লবণাক্ততার পরিমাণ পরীক্ষা করে। কিন্তু সব পদ্ধতিই একসময় অনির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। যেমন ফরাসি বিজ্ঞানী জর্জ লুই লেক্লিয়ার্ক দ্য বাফনের পদ্ধতির কথাটা বলা যাক। তিনি বিশ্বাস করতেন, সূর্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অতি উত্তপ্ত কোনো বস্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। লোহার গোলক আর বিভিন্ন আকারের পাথর নিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর আরও নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান বাফন। ১৭৭৫ সালে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। তাঁর হিসাবে দেখা গেল, জন্মের পর থেকে পৃথিবী বর্তমানের তাপমাত্রায় আসতে প্রায় ৭৪ হাজার ৮৩২ বছর লাগা উচিত। কিন্তু এই ফলাফল অনেকেই মেনে নিতে পারল না। 


পরের শতকে আরও কিছু পরীক্ষা চালান বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে ছিল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া শুরু হতে কতটা সময় দরকার, তা নিয়ে গবেষণা। এভাবে ১৯ শতকে কোনো কিছুর বয়স নির্ধারণে দুটি পদ্ধতির জন্ম হল। এর মধ্যে প্রথমটি হল, পাথরের মোট ঘনত্ব হিসাব করা এবং কী হারে পলি জমেছে, তা হিসাব করা। এভাবে পৃথিবীর পাথরগুলো জমে উঠতে কতটা সময় লেগেছে, তা–ও নির্ণয় করা হল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন জায়গায় পাথর জমার হার পাওয়া গেল বিভিন্ন রকম। তাই এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর বয়স নির্ণয়েও বড় ধরনের পার্থক্য পাওয়া গেল। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা গেল, পাথরগুলোর বয়স ৩ থেকে ২৪০০ মিলিয়ন বছরের যেকোনোটা হতে পারে। এর সরল মানে হল, পৃথিবীর এক পাশের বয়স হয়তো পাওয়া গেল ৩ বছর, আর আরেক পাশের বয়স পাওয়া গেল ২৪০০ মিলিয়ন বছর। কিন্তু তা কি সম্ভব? একই পৃথিবীর দুই জায়গার বয়স দুই রকম হবে কেন? কাজেই এ পদ্ধতিতে আসলে কাজের কাজ কিছু হলো না। পৃথিবীর বয়সটা আগের মতোই অজানা থেকে গেল। বয়স নির্ণয়ের দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ছিল সাগরে লবণ জমা হওয়ার হার নির্ধারণ করা। নদীর জলেতে দ্রবীভূত লবণ থাকে। পাথরের ওপর দিয়ে জল প্রবাহিত হওয়ার সময় পাথর ক্ষয়ের মাধ্যমে এই লবণ আসে। এভাবে নদীর জলেতে দ্রবীভূত লবণ ধীরে ধীরে সাগরে গিয়ে জমা হয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান, শুরুতে সাগরের জল বিশুদ্ধ ছিল, তাতে এখনকার মতো লবণ ছিল না। পাথর ক্ষয় থেকে আসা লবণ ধীরে ধীরে জমে সাগরের জল বর্তমান লবণাক্ত অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং কোনোভাবে যদি জানা যায় সাগরে কী হারে লবণ জমা হয়েছে, তাহলে পৃথিবীর বয়সও জানা যাবে। কিন্তু বয়স নির্ধারণের এই পদ্ধতিও বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়ে। সে কারণে প্রথম পদ্ধতির মতো এভাবে নির্ধারিত বয়সেরও হেরফের পাওয়া যেতে লাগল। কাজেই দ্বিতীয় পদ্ধতিটিও শেষ পর্যন্ত গ্রহণীয় হল না। বাতিলের খাতায় নাম ওঠাল এটাও।


এরপর মঞ্চে আসেন বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন (আসল নাম উইলিয়াম থমসন)। ১৮৬২ সালে তিনি যুক্তি দেখান, একসময় পৃথিবী আসলে গলিত অবস্থায় ছিল। সুতরাং কত তাপমাত্রায় পাথর গলে যায় এবং কী হারে তা ঠান্ডা হয়, তা জানা গেলে পৃথিবীর ভূত্বক জমাট বেঁধে শক্ত হতে কত সময় লেগেছে, সেটি নির্ণয় করা সম্ভব। এভাবে কেলভিনের হিসাবে পৃথিবীর বয়স হওয়ার কথা ২০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর। তবে এই ফলাফল নিয়ে সেকালে বেশ শোরগোল করে ওঠেন ভূতাত্ত্বিকেরা। উনিশ শতকের একেবারে শেষ দিকে নতুন কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে সেটা ছিল রোমাঞ্চকর এক দশক। ১৮৯৫ সালের দিকে রহস্যময় এক রশ্মি আবিষ্কার করে বিশ্ববাসীকে চমকে দিলেন উইলিয়াম রন্টজেন। ভুতুড়ে ও অজানা এই রশ্মির নাম দিলেন এক্স-রে। তার পরের বছর দেখা গেল, ইউরেনিয়াম পরমাণু থেকেও প্রায় একই রকম রহস্যময় রশ্মি নির্গত হয়। পদার্থবিদ মেরি কুরি যার নাম দেন রেডিওঅ্যাকটিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। ১৮৯৭ সালে জে জে থমসন ইলেকট্রন নামের একটি কণা আবিষ্কার করে বসেন। অন্যদিকে ১৯০২ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড এবং ফ্রেডরিক সোডি আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। অবাক হয়ে তাঁরা দেখেন, তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে একটি মৌল আরেকটি মৌলে পরিণত হয়। যেমন ইউরেনিয়াম ক্ষয় হয়ে রূপান্তরিত হয় রেডিয়ামে। আবার এই রেডিয়াম মৌল ক্ষয় হয়ে রেডন গ্যাসে পরিণত হয়। কিছুদিন পর সোডি প্রমাণ করে দেখান যে এই ক্ষয় প্রক্রিয়ায় শুধু রেডন গ্যাসই নয়, তার সঙ্গে হিলিয়াম গ্যাসও থাকে। আবার খোদ রেডনই শেষ কথা নয়। রেডন অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে অন্যান্য কিছু মৌলে পরিণত হয়। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে যে হিলিয়াম তৈরি হয়, এই আবিষ্কারটা পৃথিবীর বয়স নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে হিলিয়াম গ্যাস শনাক্ত করার পর কিছু ব্যাপার বেশ সহজ হয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড বুঝতে পারলেন, হিলিয়াম উৎপাদনের হার যদি কোনোভাবে জানা যায়, তাহলে তুলনামূলক সহজ গণনার মাধ্যমে নির্ণয় করা যাবে যে ওই হিলিয়াম জমতে কতটা সময় লেগেছে। আর একই সঙ্গে তার মাধ্যমেই জানা যাবে পাথর তথা পৃথিবীর বয়সও। এক বছর পর রাদারফোর্ড তেজস্ক্রিয় ক্ষয়পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমবার একটি পাথরের বয়স নির্ণয় করেন। এভাবে তিনি পাথরটির বয়স পান ৪০ মিলিয়ন বছর।


দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁর পদ্ধতিতে বেশ বড় ধরনের একটা ত্রুটি ছিল। এই ত্রুটিটি অন্য কারও চোখে না পড়লেও লন্ডনের রয়্যাল কলেজের লেকচারার রবার্ট স্টুয়ার্টের চোখ এড়ায়নি। তিনি বলেন, হিলিয়াম গ্যাস হওয়ার কারণে তা পাথর থেকে চলে যাবে। তাই এটি আমলে না নিলে রাদারফোর্ডের পদ্ধতিতে পাথরের সঠিক বয়স নির্ণয় করা যাবে না। ১৯০৭ সালে মার্কিন রসায়নবিদ বারট্রাম বোল্টউড ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পাথর বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে সেখানে সিসা পাওয়া যাচ্ছে, যার পরিমাণ মন্দ নয়। এটি দেখে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ক্ষয়ে চূড়ান্ত ধাপ হলো লেড বা সিসা। এভাবে পাথরের বয়স নির্ধারণে অনেক দিন পর একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির দেখা পাওয়া গেল। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ কিছু পাথরের বয়স নির্ধারণ করা হলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরোনো পাথরের বয়স পাওয়া গেল ১৬৪০ মিলিয়ন বছর। এর মানে দাঁড়াচ্ছে পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে ১৬৪০ মিলিয়ন বছর। তবে ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক সোডির আইসোটোপ আবিষ্কারের পর পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে উঠল। আবার এদিকে আর্থার হোমস নামের এক বিজ্ঞানী যুক্তি দিলেন, পৃথিবীতে কিছু সিসা পাওয়া যায়, যেগুলো সম্ভবত পৃথিবী গঠিত হওয়ার পর থেকেই এখানে আছে। এদের বলা হয় আদিম সিসা। কিন্তু তিনি কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারলেন না, কোন সিসাটা তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ক্ষয়ের মাধ্যমে এসেছে আর কোন সিসাটা আদিম। কাজেই পরিষ্কার বোঝা গেল, সিসার উৎপত্তি সঠিকভাবে নির্ধারণ করা গেলে পাথর তথা পৃথিবীর বয়স নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল রয়ে যাবে।


১৯৩৮ সালে তরুণ মার্কিন পদার্থবিদ আলফ্রেড নিয়ার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ধরনের একটি ভর স্পেকট্রোমিটার নিয়ে কাজ করছিলেন। এটি দিয়ে সিসার (রাসায়নিক প্রতীক Pb) জানা আইসোটোপ শনাক্ত করতে চাচ্ছিলেন তিনি। প্রত্যাশামতোই তিনি বেশ দ্রুতই আমাদের জানা থাকা সিসার তিনটি আইসোটোপ খুঁজে পেলেন। সেগুলো হলো ২০৬Pb, ২০৭Pb ও ২০৮Pb। কিন্তু বর্ণালীর একেবারে শেষ প্রান্তে অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পেলেন তিনি। সেটি ভালোভাবে বিশ্লেষণের পর হাতে যেন চাঁদ পেলেন আলফ্রেড নিয়ার। তিনি নিশ্চতভাবে বুঝতে পারলেন, এটিই সেই আদিম সিসা বা ২০৪Pb। এভাবেই ইউরেনিয়াম-সিসা জিগস পাজলের হারিয়ে যাওয়া টুকরোর খোঁজ পাওয়া গেল। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরেক মার্কিন বিজ্ঞানী ক্ল্যারি প্যাটারসন পেলেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। তিনি এক উল্কাতে অতিক্ষুদ্র পরিমাণ সিসা শনাক্ত করতে পারেন। পরবর্তী তিন বছরে পৃথিবী, উল্কা ও অন্যান্য গ্রহের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে গবেষণা করেন তিনি। এই ফলাফল থেকে তিনি প্রমাণ দেখান, পৃথিবী, গ্রহাণু ও অন্য গ্রহগুলো একই উৎস থেকে এসেছে। আবার পৃথিবী থেকে পাওয়া নমুনা (পরে চাঁদ থেকে আনা নমুনা) এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তুলনা করে দেখা হয়। এতে প্রমাণ পাওয়া গেল যে পৃথিবী ও উল্কা একই সৌরজাগতিক উপাদান দিয়ে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে গঠিত হয়েছিল। এভাবেই অনেক প্রাচীন এক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল অবশেষে। এখন আমরা জানি, পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর (সঠিকভাবে বললে ৪.৫৪ বিলিয়ন), ১ শতাংশ কম-বেশি হতে পারে। ৬৩ বছর আগে পৃথিবীর এই বয়স নির্ধারণের পর তা খুব বেশি হেরফের হয়নি। এভাবে বিজ্ঞানীদের অনেক দিনের চেষ্টার পর অবশেষে পৃথিবীর বয়স নির্ধারিত হল।

সৌজন্যেঃ- প্রথম আলো


Thursday 11 August 2022

শান্তিপুরের নিখুঁতি

নদিয়া জেলা মানেই মিষ্টান্নের লম্বা তালিকা। জিভে জল আনা মিষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে নেই শান্তিপুরের নিখুঁতি। নিখুঁতি (বানানভেদে নিখুতি বা নিকুতি) বাংলার এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। গঠনগত দিক থেকে নিঁখুতি একটি পান্তুয়া জাতীয় মিষ্টি। এটি আকৃতিতে লম্বাটে, খানিকটা ল্যাংচার মত। এর বাইরেটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম। পরিবেশনের সময় নিখুঁতির উপর হালকা গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নিখুঁতির পায়েসও ভীষণ জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শান্তিপুরের নিখুঁতি অতি বিখ্যাত। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নদিয়া জেলার পর্যটন উন্নয়নের জন্য শান্তিপুরের নিখুঁতিকে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরে।



সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে শান্তিপুরের ময়রাদের বেশ একটা সখ্য তৈরী হয় চিনির দৌলতে। খেজুর গুড় থেকে তৈরী ডেলা চিনির সে সময়ে শান্তিপুরে বিশেষ চল ছিল। সাহেবদেরও মুখে বেশ রুচত সেই মিষ্টি চিনির সেই ডেলা। জাহাজে করে সে চিনি বিলেতেও পাড়ি দিত। সে সময়ে শান্তিপুর গো-ভাগাড় মোড়ে ছিল ‘ইন্দ্র ময়রার’ বাড়ি। সে চিনির জন্য বিখ্যাত ওই কারিগরদের পদবী ছিল ইন্দ্র। তবে সে সময় ইন্দ্র ময়রার বাড়ির খ্যাতির অন্য একটি কারণ হল পরিবারের এক রূপবতী কন্যার নিখুঁত রূপ।


নিখুঁতি সাইজে আঙুলের মতো ছোট্ট হলে কী হবে, শান্তিপুরের এই মিষ্টির খ্যাতি কিন্তু মোটেই কম নয়। প্রায় ১৬০-১৭০ বছরের প্রাচীন এই মিষ্টির নামের পিছনেও রয়েছে আশ্চর্য গল্প।

স্থানীয় গবেষকদের দাবি, সময়টা ছিল ১৮৫৬ সালের আশপাশে। শান্তিপুরের গো-ভাগাড় মোড়ের কাছে ছিল ইন্দ্র ময়রার বাড়ি ও দোকান। মতভেদে অবশ্য তাঁর নাম ভোলাও বলেন কেউ কেউ। নিখুঁতি নামে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা ছিল তাঁর। সেই কিশোরী প্রায়ই গিয়ে হাজির হতো বাবার দোকানে। একদিন ময়রার অনুপস্থিতিতে এক কাণ্ড ঘটায় সে। দোকানের উনুনে চাপানো কড়াইতে ফেলে দেয় ছোট, ছোট করে পাকানো ছানার দলা। নিমেষে সেই ছানা ভাজা হয়ে যায়। লাল রঙা সেই ভাজা ছানা রসের গামলায় ফেলে পালায় কিশোরী। দোকানে ফিরে মেয়ের কাণ্ড দেখে ময়রা তো রাগে অগ্নিশর্মা। এমন সময় এলেন এক পরিচিত ক্রেতা। দোকানে তখন অন্য কিছু না থাকায় মেয়ের তৈরি মিষ্টি তাঁকে বিক্রি করেন ময়রা। স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পরদিন সাতসকালে সেই ক্রেতা আবার এসে হাজির দোকানে। জানতে চাইলেন নতুন মিষ্টির নাম। ময়রা আবার কানে কম শুনতেন। তিনি ভাবলেন, ক্রেতা জানতে চাইছেন কে তৈরি করেছে? উত্তর দিলেন, নিখুঁতি। ব্যস, সেই থেকে বঙ্গবাসী পেয়ে গেল নতুন স্বাদের মিষ্টি। 


শান্তিপুরের নিখুঁতি লাটবেলাট থেকে স্যার আশুতোষের মতো মানুষের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। নিখুঁতি গড়ার কারিগর সেই ইন্দ্র পরিবারের দোকান বহুকাল উঠে গিয়েছে। কিন্তু শান্তিপুরের নিখুঁতি এখনও সমান জনপ্রিয়। কড়া করে ভেজে তারপর হালকা রসে ডুবিয়ে পরিবেশনের আগে উপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ানো নিখুঁতি তৈরী করে না, এমন মিষ্টির দোকান শান্তিপুরে নেই বললেই চলে। তবে কাশ্যপ পাড়ায় চাকফেরা গোস্বামী বাড়ির সংলগ্ন পশু ময়রার নিখুঁতি এখনও সেই ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে চলেছে।


রসগোল্লার জন্য বাংলা যদি ‘জিআই’ (উৎপত্তি স্থল হিসেবে ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা ভৌগোলিক নির্দেশ) মর্যাদা পেতে পারে, তা হলে নিখুঁতির জন্য শান্তিপুরই বা পাবে না কেন?

শান্তিপুর বলছে, যদি নিখুঁতি বলে কোনও মিষ্টি আপনি চেখেই থাকেন, তবে এক বার এই শহরের নামটি আপনাকে স্মরণ করতেই হবে। কেননা পান্তুয়ার সঙ্গে রানাঘাট আর সরভাজার সঙ্গে কৃষ্ণনগর যে ভাবে জড়িয়ে, নিখুঁতির সঙ্গে শান্তিপুরও তা-ই। আকারে ল্যাংচার চেয়ে ছোট, অনেকটা আঙুলের মত দেখতে এই নিখুঁতিই দুই শতাব্দী ধরে ভোজনরসিকদের তৃপ্ত করে আসছে। নিখুঁতির জন্য ময়দানে লড়তে নেমেছে শান্তিপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ী ও শান্তিপুর পৌরসভা। এ শহরের নিখুঁতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। আমাদেরই ‘জিআই’ স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। সকল তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।


তথ্যসূত্র : 

১) Wikipedia 

২) আনন্দবাজার পত্রিকা ।

৩) বর্তমান পত্রিকা ।

৪) শান্তিপুর পরিচয় - কল্যাণী নাগ।


লেখক: 

অয়ন বিশ্বাস 

ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদিয়া ।

Wednesday 10 August 2022

উত্তরাখন্ডের কঙ্কাল হ্রদ রূপকুন্ড


হিমালয়ের কোলে অবস্থিত ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের চামোলি জেলার অন্তর্গত রূপকুন্ড হ্রদ (Roopkund Lake) একটি হিমবাহজাত হ্রদ, যা কঙ্কাল হ্রদ (Skeleton Lake) নামে পরিচিত। 



হিমালয়ের ত্রিশূল পর্বতের পাদদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০২৯ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত রূপকুন্ড হ্রদের ব্যাস ৪০ মিটারের মতো এবং গড় গভীরতা মাত্র ৩ মিটার। রূপকুন্ড হ্রদে এবং হ্রদের চারিপাশে প্রচুর সংখ্যক মানব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হওয়ার কারনে, এই হ্রদটি 'কঙ্কাল হ্রদ' নামে পরিচিত। ১৯৪২ সালে ফরেস্ট রেঞ্জার হরি কৃষাণ মাধওয়াল রূপকুন্ডে মানব কঙ্কাল আবিষ্কার করেন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৬০০-৮০০ টি মানব কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতি বছর তুষার গলনের সময় এখানে মানব কঙ্কালগুলি দৃশ্যমান হয়। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, এই কঙ্কালগুলি কনৌজের রাজা, রানী ও তাঁদের দলবলের, যাঁরা নন্দাদেবী দর্শনে গিয়ে প্রবল ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে রূপকুন্ড হ্রদের নিকট প্রাণ হারান। রূপকুন্ড হ্রদের মানব কঙ্কালগুলির নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। গবেষণাতে কঙ্কালগুলির খুলিতে ওপর থেকে গোলাকার বস্তুর আঘাত পাওয়া গেছে। ফলে, মৃত্যুর কারন হিসেবে শিলাবৃষ্টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে নেচার কমিউনিকেশনস্-এর সাম্প্রতিক গবেষণাতে ৩৮ টি মানব কঙ্কালের (২৩ টি পুরুষ, ১৫ টি মহিলা) রেডিওকার্বন ডেটিং এবং জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কঙ্কালগুলি দুটি ভিন্ন সময়কালের এবং পূর্বপুরুষ অনুসারে তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এক, ২৩ টি কঙ্কাল দক্ষিণ এশীয় গোষ্ঠীর (সময়কাল ৮০০ খ্রিস্টাব্দ), দুই, ১ টি কঙ্কাল দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় গোষ্ঠীর (সময়কাল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং তিন, ১৪ টি কঙ্কাল পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর (বিশেষত গ্রিস ও ক্রিট) (সময়কাল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। কঙ্কালগুলির ভিন্ন সময়কাল এবং পূর্বপুরুষ গোষ্ঠী অনেক রহস্যের সৃষ্টি করেছে। এখনও অবদি যা মীমাংসা করা যায়নি। 

Saturday 6 August 2022

হেঁটে চলে বেড়ানো গাছ 'ক্যাশাপোনা' (Cashapona)


আমরা সবাই জীবনবিজ্ঞানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর পার্থক্য পড়েছি। আমরা জানি, উদ্ভিদ স্বেচ্ছায় স্থান পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু প্রাণী গমনে সক্ষম। অর্থাৎ গাছ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারে না। কিন্তু এমন এক গাছ রয়েছে, যে কি না লম্বা লম্বা ‘পা’ ফেলে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। শুনে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই! মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার গভীর নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যে এমনই এক গাছ রয়েছে। নাম ক্যাশাপোনা (Cashapona), যা চলমান পাম (Walking Palm) নামেও পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Socratea exorrhiza।



 ক্যাশাপোনা পাম গোত্রেরই গাছ। এই গাছের উচ্চতা হয় প্রায় ১৬-২০ মিটার এবং ব্যাস ১২-১৬ সেমি। এবার জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে স্থান পরিবর্তন করে এই গাছ? ক্যাশাপোনা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী, ব্রাতিস্লাভার স্লোভাক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর প্যালিওবোটানিস্ট পিটার ভ্র্যানস্কি। জীবাশ্ম থেকে প্রাচীন গাছপালার নমুনা সংগ্রহ করেন তিনি। দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরের ওই গভীর জঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। সেখানেই ক্যাশাপোনার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। উদ্ভিদ হয়েও কেন জায়গা পরিবর্তন করে, তা খতিয়ে দেখেছেন পিটার। তিনি জানিয়েছেন, এই বনাঞ্চলে ভূমিক্ষয় হয় বেশি। এর জেরে অনেক সময় গাছের শিকড়ের পাশ থেকে মাটি সরে যায়। ফলে নড়বড়ে হয়ে যায় গাছের ভিতও। টিকে থাকতে সেই সময় দরকার হয় শক্ত মাটির। তাই তড়িঘড়ি ক্যাশাপোনা গাছগুলি ঠেসমূলের মতো নতুন শিকড় তৈরি করে। সেই নতুন শিকড় শক্ত মাটিতে ক্রমশ গেঁথে যেতে থাকে। অন্যদিকে পুরনো শিকড়গুলো ধীরে ধীরে মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে গাছটি নিজের পুরনো অবস্থান থেকে খানিকটা সরে যায়। বিশেষ প্রকার ঠেসমূল বা ‘স্টিল রুট’ দিয়ে তাদের এই আনাগোনাকে অনেকেই মানুষের ‘হাঁটা’র সঙ্গে তুলনা করছেন। এভাবে কখনও কখনও নিজের অবস্থান থেকে দিনে দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার পর্যন্ত সরে সরে যায় গাছগুলি। পিটার জানিয়েছেন, এভাবে পুরোপুরি জায়গা বদল করতে একটি গাছের প্রায় দু’বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। কখনও কখনও নিজের প্রথম অবস্থান থেকে প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত সরে যেতে দেখা যায় গাছগুলিকে। শুধু তাই নয়, পড়শি কোনও গাছ গায়ে ঢলে পড়াও একেব্বারে না-পসন্দ ক্যাশাপোনার। সেক্ষেত্রে ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে চুপচাপ গুটিগুটি পায়ে স্থান বদল করে পাম গোত্রের এই গাছ। ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটো থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেকের পথ। তারপরই শুরু জঙ্গলের রাস্তা। বেশ কয়েকঘণ্টার দুর্গম পথ পেরিয়ে গেলেই মিলবে সুমাকো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ। সেখানেই রয়েছে আজব এই গাছ।

তথ্যসূত্রঃ- বর্তমান পত্রিকা

Friday 5 August 2022

বর্ষায় অমঙ্গল বজ্রপাত

বর্ষাকাল মানেই চারিদিকে মেঘের গর্জন। মিশকালো মেঘের বুক চিরে নামছে আলোর ঝলকানি। ‘বর্ষামঙ্গল’-এ অমঙ্গলের বজ্রপাত। প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ। এই বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকে সঞ্চয় করে রাখার কোনও কৌশল বিজ্ঞানীরা এখনও রপ্ত করতে পারেননি। যদি সেটা সম্ভব হয়, তাহলে আর দেশ তথা বিশ্বের বুকে আঁধার নেমে আসবে না। মিটে যাবে বিদ্যুতের যাবতীয় চাহিদা। ঠিক যেভাবে সৌরশক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। কিন্তু, বজ্রপাত কী? ছোটবেলা থেকে ধারণা, মেঘে মেঘে সংঘর্ষের কারণে বজ্রপাত হয়। না, এই তত্ত্ব একেবারেই ভুল।


★ বজ্রপাত কী?

মেঘের বৈদ্যুতিক চার্জ যুক্ত অঞ্চল থেকে হঠাৎ চার্জ নিঃসরণ। এই চার্জ নিঃসরণ মূলত মেঘ ও ভূমির মধ্যে বা পাশাপাশি, দুই মেঘের মধ্যে চার্জের তারতম্যের কারণেও হয়। তবে বেশিরভাগ সময়েই বজ্রপাত মেঘে মেঘে ঘটে থাকে। আসলে মেঘে থাকে জলের ছোট ছোট কণা। আর উপরে উঠতে উঠতে জলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এই জলরাশির পরিমাণ যখন ৫ মিলিমিটারের বেশি হয়, তখন আর জলের অণুগুলো পারস্পরিক বন্ধন ধরে রাখতে পারে না। ক্রমশ পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। ফলে সেখানে বৈদ্যুতিক আধানের সৃষ্টি হয়। এই আধানের মান নীচের অংশের তুলনায় উপরের অংশে বেশি থাকে। উপরের অংশে পজিটিভ এবং নীচের অংশে নেগেটিভ চার্জ থাকে। আমরা জানি, চার্জ বা আধান সবসময় উচ্চ থেকে নিম্ন বিভবের স্থানে প্রবাহিত হয়। এই কারণেই উপর হতে নীচের দিকে বৈদ্যুতিক আধানের নির্গমণ হয়। ফলে প্রথমে আমরা আলোর ঝলকানি দেখতে পাই। পৃথিবীর আধান যেহেতু শূন্য, তাই মেঘে পুঞ্জীভূত চার্জ নিস্তড়িৎ হওয়ার জন্য ভূমির দিকে ধেয়ে আসে। চার্জগুলো যখন প্রচণ্ড গতিতে ভূমির দিকে আসতে থাকে, তখন বৃষ্টির জল ও বায়ুর কণার সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে। এতে বিপুল তাপ উৎপন্ন হয়, যা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি তৈরি করে। এই উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিই হল বজ্রপাত।



★ শব্দ কেন হয়?

আধান নিস্তড়িৎ হওয়ার সময় প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আর এই প্রবল সংঘর্ষের কারণেই সৃষ্টি বিকট শব্দ।


★ বজ্রপাতের তাপমাত্রা কত? 

শুনলে আশ্চর্য হবেন, একটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ২৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। এই তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার থেকে কয়েক গুণ বেশি। 


★ কত শক্তি? 

ভূমি থেকে তিন মাইল দূরত্বের বজ্রপাত ১০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি জুল শক্তি উৎপন্ন করে। বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপের একক কিলোওয়াট/ আওয়ার। এই হিসেবে বজ্রপাতের শক্তি প্রায় ২৭ হাজার ৮৪০ কিলোওয়াট/আওয়ার।


★ কত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়? 

একটি বজ্রপাতের ফ্ল্যাশ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট এবং প্রায় ৩০ হাজার অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। যেখানে নিত্যজীবনে ২২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়।


★ বজ্রপাত কোথায় বেশি হয়?

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়ে থাকে ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো হ্রদে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, প্রতি বছর হ্রদটির প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকার উপর গড়ে ২৩৩টি বজ্রপাত হয়। 


তবে, বজ্রপাত শুধু অমঙ্গলই সাধন করে না। ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে এর অবদান রয়েছে। শুধু আমাদের জীবনহানি রোধ করতে হবে। আর সেজন্য যা যা করণীয় : (১) কোনও গাছের নীচে আশ্রয় না নেওয়া। কেননা, গাছের উপরই বেশি বাজ পড়ে। (২) জলাশয়ের কাছাকাছি না থাকা। জল বিদ্যুতের সুপরিবাহী। (৩) রাস্তায় সাইকেল কিংবা মোটর না থাকা। (৪) কংক্রিটের জায়গা বা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া দরকার। কখনওই জানলার কাছে থাকা চলবে না। (৫) গাড়ির ভিতর থাকলে পায়ে জুতো পরে নিতে হবে। পা সিটের উপর তুলে বসলে বেশি ভালো। কোনওভাবেই যেন শরীর গাড়ির বডি বা ধাতব কোন কিছু স্পর্শ না করে। (৬) বজ্রপাতের সময় বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা এবং বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন করে রাখা উচিত। (৭) বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা ধানখেতে থাকলে তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে। (৮) যদি অনেকে একসঙ্গে থাকে, তাহলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যাওয়া উচিত। (৯) অনেকসময় বজ্রপাতের আগে বিদ্যুতের প্রভাবে চুল খাড়া হয়ে যেতে পারে। ত্বক শিরশির করা বা বিদ্যুৎ অনুভূত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এমন কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেলে বুঝতে হবে, কাছাকাছি বজ্রপাত হবে। এক্ষেত্রে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া উচিত। (১০) বজ্রাহত ব্যক্তিকে খালি হাতে স্পর্শ করা উচিত নয়। তাঁর শরীর কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুতের আধারে পরিণত হয়ে যায়।

তথ্যসূত্রঃ- বর্তমান পত্রিকা