নদিয়া জেলা মানেই মিষ্টান্নের লম্বা তালিকা। জিভে জল আনা মিষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে নেই শান্তিপুরের নিখুঁতি। নিখুঁতি (বানানভেদে নিখুতি বা নিকুতি) বাংলার এক অতি জনপ্রিয় মিষ্টি। গঠনগত দিক থেকে নিঁখুতি একটি পান্তুয়া জাতীয় মিষ্টি। এটি আকৃতিতে লম্বাটে, খানিকটা ল্যাংচার মত। এর বাইরেটা শক্ত কিন্তু ভেতরটা নরম। পরিবেশনের সময় নিখুঁতির উপর হালকা গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নিখুঁতির পায়েসও ভীষণ জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শান্তিপুরের নিখুঁতি অতি বিখ্যাত। ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নদিয়া জেলার পর্যটন উন্নয়নের জন্য শান্তিপুরের নিখুঁতিকে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে তুলে ধরে।
সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকে শান্তিপুরের ময়রাদের বেশ একটা সখ্য তৈরী হয় চিনির দৌলতে। খেজুর গুড় থেকে তৈরী ডেলা চিনির সে সময়ে শান্তিপুরে বিশেষ চল ছিল। সাহেবদেরও মুখে বেশ রুচত সেই মিষ্টি চিনির সেই ডেলা। জাহাজে করে সে চিনি বিলেতেও পাড়ি দিত। সে সময়ে শান্তিপুর গো-ভাগাড় মোড়ে ছিল ‘ইন্দ্র ময়রার’ বাড়ি। সে চিনির জন্য বিখ্যাত ওই কারিগরদের পদবী ছিল ইন্দ্র। তবে সে সময় ইন্দ্র ময়রার বাড়ির খ্যাতির অন্য একটি কারণ হল পরিবারের এক রূপবতী কন্যার নিখুঁত রূপ।
নিখুঁতি সাইজে আঙুলের মতো ছোট্ট হলে কী হবে, শান্তিপুরের এই মিষ্টির খ্যাতি কিন্তু মোটেই কম নয়। প্রায় ১৬০-১৭০ বছরের প্রাচীন এই মিষ্টির নামের পিছনেও রয়েছে আশ্চর্য গল্প।
স্থানীয় গবেষকদের দাবি, সময়টা ছিল ১৮৫৬ সালের আশপাশে। শান্তিপুরের গো-ভাগাড় মোড়ের কাছে ছিল ইন্দ্র ময়রার বাড়ি ও দোকান। মতভেদে অবশ্য তাঁর নাম ভোলাও বলেন কেউ কেউ। নিখুঁতি নামে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা ছিল তাঁর। সেই কিশোরী প্রায়ই গিয়ে হাজির হতো বাবার দোকানে। একদিন ময়রার অনুপস্থিতিতে এক কাণ্ড ঘটায় সে। দোকানের উনুনে চাপানো কড়াইতে ফেলে দেয় ছোট, ছোট করে পাকানো ছানার দলা। নিমেষে সেই ছানা ভাজা হয়ে যায়। লাল রঙা সেই ভাজা ছানা রসের গামলায় ফেলে পালায় কিশোরী। দোকানে ফিরে মেয়ের কাণ্ড দেখে ময়রা তো রাগে অগ্নিশর্মা। এমন সময় এলেন এক পরিচিত ক্রেতা। দোকানে তখন অন্য কিছু না থাকায় মেয়ের তৈরি মিষ্টি তাঁকে বিক্রি করেন ময়রা। স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পরদিন সাতসকালে সেই ক্রেতা আবার এসে হাজির দোকানে। জানতে চাইলেন নতুন মিষ্টির নাম। ময়রা আবার কানে কম শুনতেন। তিনি ভাবলেন, ক্রেতা জানতে চাইছেন কে তৈরি করেছে? উত্তর দিলেন, নিখুঁতি। ব্যস, সেই থেকে বঙ্গবাসী পেয়ে গেল নতুন স্বাদের মিষ্টি।
শান্তিপুরের নিখুঁতি লাটবেলাট থেকে স্যার আশুতোষের মতো মানুষের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। নিখুঁতি গড়ার কারিগর সেই ইন্দ্র পরিবারের দোকান বহুকাল উঠে গিয়েছে। কিন্তু শান্তিপুরের নিখুঁতি এখনও সমান জনপ্রিয়। কড়া করে ভেজে তারপর হালকা রসে ডুবিয়ে পরিবেশনের আগে উপরে গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ানো নিখুঁতি তৈরী করে না, এমন মিষ্টির দোকান শান্তিপুরে নেই বললেই চলে। তবে কাশ্যপ পাড়ায় চাকফেরা গোস্বামী বাড়ির সংলগ্ন পশু ময়রার নিখুঁতি এখনও সেই ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে চলেছে।
রসগোল্লার জন্য বাংলা যদি ‘জিআই’ (উৎপত্তি স্থল হিসেবে ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা ভৌগোলিক নির্দেশ) মর্যাদা পেতে পারে, তা হলে নিখুঁতির জন্য শান্তিপুরই বা পাবে না কেন?
শান্তিপুর বলছে, যদি নিখুঁতি বলে কোনও মিষ্টি আপনি চেখেই থাকেন, তবে এক বার এই শহরের নামটি আপনাকে স্মরণ করতেই হবে। কেননা পান্তুয়ার সঙ্গে রানাঘাট আর সরভাজার সঙ্গে কৃষ্ণনগর যে ভাবে জড়িয়ে, নিখুঁতির সঙ্গে শান্তিপুরও তা-ই। আকারে ল্যাংচার চেয়ে ছোট, অনেকটা আঙুলের মত দেখতে এই নিখুঁতিই দুই শতাব্দী ধরে ভোজনরসিকদের তৃপ্ত করে আসছে। নিখুঁতির জন্য ময়দানে লড়তে নেমেছে শান্তিপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ী ও শান্তিপুর পৌরসভা। এ শহরের নিখুঁতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। আমাদেরই ‘জিআই’ স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। সকল তথ্য সংগ্রহ করে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র :
১) Wikipedia
২) আনন্দবাজার পত্রিকা ।
৩) বর্তমান পত্রিকা ।
৪) শান্তিপুর পরিচয় - কল্যাণী নাগ।
লেখক:
অয়ন বিশ্বাস
ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদিয়া ।
No comments:
Post a Comment