Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Sunday 26 July 2020

বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গনগনি


        'ক্যানিয়ন' বললে প্রথমেই মনে পড়ে যায় ভূগোলের বইতে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুক্ত 'অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের' কথা, নদীর স্রোতের শিল্পকর্মের নিদর্শন হল এই ক্যানিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ লক্ষ পর্যটক যান। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই জানেন না যে, খোদ বাংলাতেই রয়েছে অবিকল এমনই একটি জায়গা যা বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম  মেদিনীপুর জেলার গড়বেতার গনগনিকে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলা হয়। এর স্থানাঙ্ক ২২ ডিগ্রি ৫১মিনিট ২৪ সেকেন্ড উত্তর , ৮৭ ডিগ্রি ২০ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পূর্ব।
           শীলাবতী নদীর পাশে অবস্থিত এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কোনও অংশেই কম নয়। সপ্তাহান্তে ভ্রমণের আদর্শ জায়গা।শিলাবতী নদীর তীরে গড়বেতার অন্যতম পর্যটনস্থল গনগনি। মেদিনীপুর শহর থেকে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার। কানায় কানায় ভরা প্রকৃতি। পাথুরে খাদের উপর আকাশের ডাকাডাকি। গায়ে গেরুয়া ওড়না জড়িয়ে দাঁড়িয়ে গনগনি। বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। 

         প্রকৃতিই এখানে শিল্পী। তার আপন খেয়ালেই সেজে উঠেছে নিসর্গের এলাকাটি।একেবারে গা ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে শিলাবতী। পাশে ক্ষয়িষ্ণু ভূমি। সূর্য হেলে যখন নদীজলে খেলা করে তখন সেই ভূমি আরও লাল হয়ে ওঠে। অপরূপ সৌন্দর্য্য।  নদীপাড় ক্ষয়ে মাঝে মাঝে তৈরি হয়েছে বিস্তৃত পাথুরে ভূমি। ক্ষয়িষ্ণু এই প্রস্তরেই সৌন্দর্য্য ঝলসে ওঠে। অনেকটা আমেরিকার ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’- এর মতোই দেখতে রূপসী বাংলার এই গনগনি।
আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মিনিয়েচার ভার্সন খুঁজে পাবেন আমাদের রাজ্যেই। অ্যারিজোনার জায়গায় গনগনি। আর কলোরাডোর জায়গায় শিলাই নদী!
মেদিনীপুরের গড়বেতার কাছে গনগনিতে নদীপাড় ক্ষয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে বিস্তৃত র‌্যাভাইন। ছোটখাটো ক্যানিয়ন বললেও ভুল হবে না। শিলাবতী নদী, যার ডাক নাম শিলাই এঁকেবেঁকে চলেছে এখানে। শিলাবতীর চরে প্রকৃতিই তৈরি করেছে এই ক্যানিয়ন। এখানে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতা একটু বেশি। নদীর ক্ষয়ের ফলে ল্যাটেরাইটে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ।

        শিলাবতী, আদরের নাম শিলাই। দৈর্ঘ্যে খুব বড় নয় সে। ছোটনাগপুরের মালভূমিতে তার জন্ম, পুরুলিয়ার পুঞ্চা শহরের কাছে। তার পর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা দিয়ে বয়ে গেছে। ঘাটালের কাছে দ্বারকেশ্বর নদের সঙ্গে মিশেছে। এই ছোট্ট শিলাই প্রায় সারা বছর শুয়ে থাকে, অত্যন্ত রুগ্ন, শীর্ণ চেহারা তার। কিন্তু বর্ষা এলেই তার রুদ্র রূপ, ভাসিয়ে দেয় চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই আর ঘাটাল। এ হেন শিলাবতীর কেরামতিতে সৃষ্টি এই গনগনির ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’।

        গনগনি আজ থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন থেকে দশ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ের সঞ্চিত কাঁকুরে পলল স্তরের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমান্বয়ে ঋতুগত ভৌমজলস্তরের ওঠানামার ফলে আদ্রতা ও শুষ্কতার প্রভাবে তৈরি হওয়া ল্যাটেরাইটের প্রকাশ। শিলাবতী নদীর ডানদিকের পাড় বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ৩০ মিটার উঁচু এই ডাঙার খাড়া ঢাল বরাবর গভীর ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট অজস্র ছোট ছোট নালা এবং নালাগুলির সংযুক্তির ফলে সৃষ্টি হওয়া অসংখ্য গালির সমন্বয়ে এই ক্ষয়িষ্ণু ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।

        এত গেল ভৌগলিক ব্যাখা,এই গনগনিকে ঘিরে রয়েছে এই অঞ্চলের লোককাহিনি, রয়েছে ইতিহাস। যে ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে এক টুকরো মহাভারত। সেই ইতিহাসের শিকড় পৌরাণিক যুগে মহাভারত অব্দি বিস্তৃত। অজ্ঞাতবাসে থাকার সময় পঞ্চপাণ্ডব এখানে নাকি কিছু দিন কাটিয়েছিলেন।পাণ্ডবরা বনবাসে থাকাকালীন একদিন এসে পড়েছিলেন এই গনগনি তে। এই তল্লাটে তখন দাপিয়ে বেড়াত বকাসুর নামের রাক্ষস। কোনো একজন গ্রামবাসীকে রোজ তার হাতে তুলে দিতে হত নৈবেদ্য হিসেবে। এর অন্যথা হলে, সমস্ত গ্রাম তছনছ করে ছাড়তো বকাসুর। পাণ্ডবরা এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। বকাসুরের খাদ্য হিসেবে উৎসর্গ হওয়ার জন্য একদিন সময় এলো এই পরিবারের। মাতা কুন্তীর নির্দেশে ভীম এই পরিবারের সদস্য হয়ে নিবেদিত হলো বকাসুরের কাছে। শুরু হলো প্রবল যুদ্ধ বকাসুরের সাথে শক্তিশালী ভীমের। অবশেষে ভীমের হাতেই বধ হলো বকাসুর। তাদের যুদ্ধের প্রতাপে এখানকার মাটি কেঁপে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শিলাবতীর এই গিরিখাত আসলে বকরাক্ষস আর ভীমের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়েছিল তার ফলেই তৈরি হয়েছিল।লোককথা অনুযায়ী, এই জায়গাতেই নাকি বকাসুরকে বধ করেছিলেন ভীম। আর ক্যানিয়নের গুহার মতো অংশগুলো জনশ্রুতিতে হয়ে গিয়েছে পাণ্ডবদের গুহা! 

        কল্পকাহিনী ছেড়ে এবারের আসি ইতিহাসে পাতায়। চূয়াড়-লায়েক বিদ্রোহ তো বেশি দিনের কথা নয়। মোটামুটি দু’শো বছর আগের কথা। ১৭৯৮ - ৯৯ সালে চূয়াড় বিদ্রোহ চড়িয়ে পড়েছিল মেদিনীপুর জেলায়। বহু চূয়াড় নেতা সদলবলে আত্মগোপন করেছিলেন গনগনিতে।বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে আস্তানা গেড়েছিলেন গনগনির গভীর শালবনে, রপ্ত করেছিলেন গেরিলা লড়াইয়ের কলাকৌশল। ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। ইংরেজ বাহিনী নাকি কামান দেগে গোটা শালবন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তবু দমানো যায়নি অচলকে। চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যান তিনি। অবশ্য শেষরক্ষা করতে পারেননি। বগড়ির শেষ রাজা ছত্র সিংহ ধরিয়ে দেন অচলদের। এই গনগনির মাঠেই নাকি অচল ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দিয়েছিল ইংরেজ। 

         ইতিহাস , ভূগোল , পুরান বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই প্রতি বছরই অনেক পর্যটক এখানে আসেন। প্রকৃতির এই সৃষ্টির কাছে যেন মাথা নোয়ায় মানুষের সৃষ্টি। সেই দিক থেকে গনগনি আর পাঁচটা পর্যটনস্থলের থেকে একেবারে আলাদা। একেবারে অন্য রকম।

         বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদী গিয়ে আছড়ে পড়ে পাশের উঁচু টিলায়। পাশাপাশি বৃষ্টিতেও ভূমিক্ষয় হয়। সেই ভূমিক্ষয় থেকেই তৈরি হয়েছে ছোট ছোট টিলা, গর্ত, খাল। তাতে আবার রঙের বৈচিত্র্য। কোথাও সাদা, কোথাও লালচে বা ধূসর। কোনও অংশ দেখে আবার মনে হবে যেন মন্দির, আবার কোনও অংশ মনুষ্য আকৃতির, কোথাও বা টিলা গুহার আকার নিয়েছে। ভূগোলের ছাত্রছাত্রী থেকে গবেষক, ভূমিক্ষয় নিয়ে গবেষণার জন্য অনেকেই এখানে আসেন। আর ভ্রমণ-পিপাসু মানুষ আসেন ভূমিক্ষয়ের ফলে তৈরি প্রকৃতির শিল্পকর্ম দেখতে। শীতের  দুপুরে গনগনি যেন সত্যিই রঙের লাবণ্যে গনগন করে ওঠে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় গনগনির রূপ সবচেয়ে সুন্দর। গনগনি-র রূপ যেন মোহময়ী। এই সময়ে জায়গাটাকে ফোটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য বললেও অত্যুক্তি হবে না।

তথ্যসূত্র :
1. www.bongodorshon.com
2. https://ebela.in 
3. https://www.anandabazar.com
4.https://www.jiyobangla.com
5. https://wikipedia.org

লেখক:
অয়ন বিশ্বাস
বি.এসসি, এম.এ(ভূগোল), বি. এড্
ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদিয়া।


.........................................................................................................
লেখকের লিখিত অনুমতি ছাড়া সমগ্র বা আংশিক অংশ প্রতিলিপি করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কোন তথ্যের সমগ্র আংশিক ব্যবহার মুদ্রণ বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে (জিংক, টেক, স্ক্যান, পিডিএফ ইত্যাদি) পুনরুৎপাদন করা নিষিদ্ধ। এই শর্ত লঙ্খন করা হলে আইনের সাহায্য নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

No comments:

Post a Comment