বারাসাত, ব্যারাকপুর, বারুইপুরের মত জায়গায় থাকার জন্য যদি প্রতিনিয়ত আপনাকে শুনতে হয় আপনি উদ্বাস্তু, গ্রাম থেকে শহরে কাজের খোঁজে আসেন, তা হলে এবার আপনার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। কলকাতার বাইরেও যে একটা বাংলা রয়েছে, কিংবা মুম্বইয়ের বাইরে একটা মহারাষ্ট্র তার রূপক হয়ে এই দেশের বুকে বেড়ে উঠছে আর এক শহর৷ না, কলকাতার শহুরে বাবুদের শহরে থাকার প্রত্যক্ষ গরিমায় আর জটিলতা নয়, তথাকথিত জঙ্গলের দেশ ঝাড়খণ্ডে সবুজের মধ্যে সকলে একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠা স্বপ্নের শহর, জামশেদপুর৷
জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম শাকচি, আর সেই শাকচির পাশেই একদিন খুঁজে পাওয়া গেল এক ধাতু। এ দেশের ধুলোবালিতে মিশে আছে লোহা৷ আর সেই লোহার খোঁজে শাকচির পাশে বাসা বাঁধল সেই সময়ে দেশের সবথেকে বড় কোম্পানি টাটা গোষ্ঠী। কিন্তু না, গল্পটা বাকি কোম্পানির সাথে সেখানকার লোকেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের নয়, বরং কিছুটা উল্টো৷ লালমাটি আর বন্ধ্যা জমির দেশ ঝাড়খণ্ডে তারা স্থাপন করল এ দেশের প্রথম স্টিল কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর। শুরু হল কাজ। স্থানীয় লোকেরাই তুলে নিল কারখানা দাঁড় করানোর দায়িত্ব৷ তারা বুঝল এ জমির বুকে রয়েছে তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ, আর সেই রসদকে দেশের সামনে তুলে ধরতে পারে একমাত্র এই কোম্পানিই৷ কিন্তু শুধু কারখানা তৈরি করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন সেই কোম্পানি চালানোর লোকেদের বাসস্থানের জায়গা। আর শুধুই কি কোম্পানির বাবু আর সাহেবদের ঘর? জামশেদজি টাটা কোনও দিন আলাদা করেননি তাঁর শ্রমিকদের। কারখানার পরিবারে শ্রমিকরাও সদস্য। কারখানার সমস্ত শ্রমিকদের জন্যও তৈরি হবে ঘর।
সমস্ত শ্রমিকদের জন্য যদি বাসস্থান তৈরি করতে হয় তা হলে হিসাব করে দেখা গেল ছোটখাটো একটা শহর তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু তাতেও পিছপা হলেন না জামশেদজী। আমেরিকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এল। জুলিয়ান কেনেডি এবং এক্সেল শাহিন। আমেরিকার পিটসবার্গের বিখ্যাত স্টিল সিটির আদলে প্ল্যান করা হল জামশেদপুর শহরের৷ প্রথম অবস্থাতেই দশ হাজার কর্মীর বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হল। গড়ে উঠতে থাকল শহর, একটু একটু করে বাস্তবে রূপ নিল কারখানাকে কেন্দ্র করে এক অলীক স্বপ্ন। সেই শহরে কী নেই- খেলার মাঠ, বাজার করার জায়গা, ম্যানেজার থেকে নিচুতলার কর্মী, সকলের জন্য বাংলো।
কিন্তু দশ হাজার লোকের শহর শুনে যারা মুচকি হেসেছিলেন, তাদের ভুল প্রমাণ করে মাত্র দশ বছরে এই শহরের লোকসংখ্যা হয়ে দাঁড়াল পঞ্চাশ হাজার। আর কালের নিজস্ব নিয়মে এই দেশ দেখল এক ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্ন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ৷ যে সমস্যার কথা কেউ কল্পনাও করেনি, সেই সমস্যাই একসাথে থাকার ফলে রুখে দিল টাটা স্টিল কারখানা৷ ১৯১৯ সালে শাকচির বাজারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতায় স্বীকার করলেন সেই সময়ের গভর্নর ও ভাইসরয়, লর্ড চেমসফোর্ড। যারা এ দেশের রেল ব্যবস্থার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইংরেজদের, তারা ভুলে যান এই দেশেরই এক কোম্পানি টাটা স্টিল বিশ্বযুদ্ধের এই সাংঘাতিক সময়ে গোটা দেশকে উপহার দিয়েছে মাইলের পর মাইল রেলের লাইন। শুধু এই দেশ নয়, ইংরেজ অধীন বিভিন্ন দেশ যেমন মেসোপোটেমিয়া, ইজিপ্ট, প্যালেস্টাইন এবং ইস্ট আফ্রিকার মত দেশেও রপ্তানি হয়েছে হাজার হাজার টন রেলের লাইন। মিত্রশক্তিকে এই সময় টাটা স্টিল উপহার দিয়েছে তিন লক্ষ টন স্টিল। আর সে কারণেই লর্ড চেমসফোর্ড এই শহরের নাম ঠিক করেন জামশেদজির নামে। ভারতীয় শিল্পের জনক জামশেদজির স্বপ্ন শহর জামশেদপুর।
কিন্তু উত্থানের সাথে পতনের কাহিনী না থাকলে উপন্যাসের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এ শহরের সদস্য সংখ্যা তখন বাড়তে বাড়তে দেড় লক্ষ। পিটসবার্গের পর এ বারে ইংল্যান্ডের নবনির্মিত শহর লেচওয়ার্থের মত করে গড়ে উঠেছে নিকাশি ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট নিয়মমাফিক মন্দির, মসজিদ, গির্জা। আয়তনে আরও বড় হয়ে দেশের বুকে হীরের মত জ্বলজ্বল করছে জামশেদপুর। আর সেই আলোই কাল হয়ে উঠল এই শহরের জন্য। চীন বর্মা ভারতের ত্রিকোণ যুদ্ধে যখন জাপান যোগদান করল, তখন এই শহর হয়ে উঠল জাপানি যুদ্ধবিমানের প্রধান বোমাবর্ষণের লক্ষ্য। রাতের পর রাত যায়, সব কিছু থমকে দিয়ে সাইরেন বেজে ওঠে, গোটা শহর অন্ধকার হয়ে বসে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, আর শব্দ শোনে বিমান উড়ে যাওয়ার৷ কিন্তু এ ভাবে বেশি দিন চলতে হল না। গার্ডেন সিটির বুকে গড়ে উঠল বাঙ্কার। হাতে হাত ধরে দু:স্বপ্নের এই রাত পেরোল জামশেদপুর।
তারপর আর কোনও দিন পিছনে ফিরে তাকায়নি এ শহর৷ ১৯৫৯-এর এক সার্ভে বলছে, এ দেশের মেধাবী ছাত্রদের অন্যতম ঠিকানা হয়েছে জামশেদপুর। শুধু স্টিল কারখানাই নয়, এ শহরের বুকে তৈরি হয়েছে টাটা মোটরস থেকে টেলকোর মত কারখানা। বাড়তে বাড়তে এখন এই শহর দশ লক্ষের মাত্রা ছুঁয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটিই দেশের একমাত্র শহর যেখানে কোনও মিউনিসিপ্যালিটি নেই। ২০০৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বিশ্বের প্রথম সারির শহরের তালিকায় সান ফ্রান্সিসকো, নাইরোবি, মেলবোর্নের পাশাপাশি নাম এসেছে জামশেদপুরের৷ শুধু উন্নতিই নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই তালিকা তৈরির সময়ে মাথায় রাখা হয়েছিল মানুষের জীবনযাত্রার মান, সরকারের সাথে পাশাপাশি ব্যবসার কৌশল, এই শহরের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার মান ইত্যাদির উপরেও। আর সেখানেই দেশের আপাত গর্বের শহরগুলিকে অনেক অনেক পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে জামশেদপুর। বন্ধ্যা জমি থেকে বিশ্বসেরার শিরোপা, এই শহর দেখিয়ে দিয়েছে যে অপমান আর তাচ্ছিল্য নিয়ে শহুরে যে গরিমায় উচ্চারিত হয় ‘জংলি’ আর ‘গেঁয়ো’-র মত শব্দগুলি, সেই গরিমা ঝরাপাতার মত ম্লান হয়ে যায় আন্তরিকতা আর দেশের মাটির সোঁদা গন্ধের সামনে।
সৌজন্যেঃ- এই সময়
No comments:
Post a Comment