ক্যানভাসে যেমন রঙ-তুলির খেলা চলে, রাতের আকাশেও কখনো কখনো প্রকৃতির রঙ আর তুলির সমন্বয়ে যেন ক্যানভাসই হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনকে তুলি আর রঙ হিসেবে পরমাণুদের ধরে নেওয়া যায়। আসল কথা হল, সূর্যের অভ্যন্তরে যে বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়, তাতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু আন্দোলিত হতে থাকে। এতে ইলেকট্রন, প্রোটন সূর্যের বায়ুমণ্ডলের উত্তপ্ত বহিস্থ স্তর করোনা থেকে দ্রুতগতিতে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এই ব্যাপারটিই সৌরবায়ু বা সৌরঝড় নামে পরিচিত। সৌরবায়ু হল মুক্ত চার্জযুক্ত প্লাজমা কণা এবং গামারশ্মি, রঞ্জনরশ্মির মতো ক্ষতিকর রশ্মির সমন্বয়ে তৈরি, যা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। পৃথিবীতে আসার সময় সৌরবায়ু নিজেই তার চারপাশে একটি চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি, যা করোনাল মাস ইজেকশন নামে পরিচিত। ১০০ কোটি পরমাণু বোমা একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটলে যে পরিমাণ শক্তির জন্ম হয়, ঠিক ততটাই শক্তিশালী এই চৌম্বকক্ষেত্র। কিন্তু পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে এরা বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে কিছু কণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে আটকে পড়ে এবং চৌম্বকরেখা বরাবর ক্রিয়া করে। এসব কণাই পরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটা স্তরে প্রবেশ করে। এই কণাগুলোর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সবচেয়ে সুবিধাজনক এলাকা হল পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল। মুক্ত প্রোটন ও ইলেকট্রনগুলো বায়ুমণ্ডলে ভাসতে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। সংঘর্ষের সময় কিছু শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি গ্রহণ করে পরমাণুর ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে প্রবেশের সুযোগ পায়। পরে নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসার সময় শক্তি বিকিরণ করে। বিকিরিত সেই শক্তিই ফোটন বা ফোটনের ঝাঁক বা আলো হিসেবে দেখা দেয়। সেই আলোকেই আমরা মেরুজ্যোতি বলে থাকি।
মেরুজ্যোতির ইংরাজি নাম অরোরা (Aurora), যা রোমান পুরাণের ভোরের দেবী অরোরার নাম থেকে এসেছে। উত্তর মেরু অঞ্চলের মেরুজ্যোতি গ্রিক পুরাণের উত্তর বায়ুর দেবতা বোরিয়াস-এর নামানুসারে 'অরোরা বোরিয়ালিস' (Aurora borealis) নামে পরিচিত। দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের মেরুজ্যোতি গ্রিক পুরাণের দক্ষিণ বায়ুর দেবতা অস্টার-এর নামানুসারে 'অরোরা অস্ট্রালিস' (Aurora australis) নামে পরিচিত। উভয় গোলার্ধে সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি উত্তর/দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে মেরুবিন্দু পর্যন্ত অঞ্চলে মেরুজ্যোতি দেখা যায়। সবক'টা রঙ কিন্তু আকাশে মেরুরেখায় দেখা সম্ভব নয়। সাধারণত অক্সিজেনের সঙ্গে সৌরকণাদের সংঘর্ষে সবুজ বা লাল রঙ দেখা যায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় এই রঙের আলো দেখা যায়। তবে ভূমি থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে যে আলো দেখা যায়, তার রঙ সবুজ, এর ওপরের রঙ লাল রঙের। অন্যদিকে নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষে গাঢ় লাল অথবা নীল রঙ দেখা যায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০ কিলোমিটার উচ্চতার কাছাকাছি গাঢ় লাল, এর বেশি উচ্চতায় সংঘর্ষ হলে নীল রঙের আলোর ঝলক দেখা যায়।
তথ্যসূত্রঃ- প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment