'ভেবে দেখেছো কি,
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে,
তারও দূরে...
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে।'
আলোকবর্ষ হল মহাজাগতিক দূরত্বের একক, সময়ের একক নয়। কেন আলোকবর্ষই মহাকাশের দূরত্বের একক? আলোকবর্ষের দূরত্ব আসলে কত বড়? সাধারণত আমরা দূরত্ব পরিমাপের জন্য মিটার বা সেন্টিমিটার ব্যবহার করি। এর চেয়ে বেশি দূরত্ব পরিমাপ করতে হলে ব্যবহার করি কিলোমিটার। এই মিটার, কিলোমিটার দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন কাজ চলে যায়। কিন্তু মহাবিশ্বের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপতে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত একক ব্যবহার করা যায় না। কারণ এই এককে মহাবিশ্ব পরিমাপ করলে অনেক বড় বড় সংখ্যা পাওয়া যায়। ফলে হিসাব অনেক জটিল হয়ে পড়ে। হিসাবের সুবিধার জন্য মহাবিশ্বের পরিমাপের জন্য আলোকবর্ষ (Light Year) ব্যবহার করা হয়। আলোকবর্ষ বলতে বোঝায়, আলো এক বছরে কত দূরত্ব অতিক্রম করে। সময় ও দূরত্বের এই সম্পর্ক আমরা দৈনন্দিন জীবনেও ব্যবহার করি। ধরুন, কোনো বন্ধুর জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন। আপনাকে ফোনে জানালেন, তিনি আর দশ মিনিট দূরত্বে আছেন। এই তথ্য দিয়েই আপনি বন্ধুর দূরত্ব সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ঠিক এই পদ্ধতিটিই কাজে লাগিয়েছেন মহাবিশ্বের দূরত্ব পরিমাপে। আর এজন্য কাজে লাগানো হয়েছে আলোর গতি।
আলোর গতিকেই কেন ব্যবহার করা হল? কারণ আলো মহাবিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগামী। আলো এক বছরে প্রায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। সুতরাং বলা যায়, এক আলোকবর্ষ বলতে বোঝায় ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার।
চাইলে আপনিও এই দূরত্ব নির্ণয় করতে পারেন। আমরা জানি, আলো শূন্য মাধ্যমে সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এক ঘণ্টা বা ৩ হাজার ৬০০ সেকেন্ডে আলো পাড়ি দেয় ১.০৮×১০^৯ কিলোমিটার পথ। তাহলে এক বছর বা ৮ হাজার ৭৬৬ ঘণ্টায় আলো ৯.৫×১০১২ বা ৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। দূরত্বটা অনেক বড় মনে হলেও আসলে মহাবিশ্বের বিশালতার হিসেবে এটা কিছুই না। কারণ সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আলফা সেন্টরাইয়ের দূরত্ব প্রায় ৪.৪ আলোকবর্ষ। আলোকবর্ষের এই দূরত্বকে মাইল বা কিলোমিটারের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো সহজ নয়। মার্কিন জ্যোতির্বিদ রবার্ট বার্নহাম জুনিয়র প্রথম একটি পন্থা খুজে পান। যার সাহায্যে খুব সহজে আলোকবর্ষের দূরত্বকে কিলোমিটার বা মাইলে বোঝানো সম্ভব।
আমরা জানি, সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। এই দূরত্বকে বলা হয় এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক বা Astronomical Unit (AU)। বার্নহাম আলোকবর্ষকে এই AU-তে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বার্নহাম দেখতে পান, এক মাইলকে ইঞ্চিতে রূপান্তর করলে যতো সংখ্যা হয়, এক আলোকবর্ষকে AU-তে রূপান্তর করলে প্রায় কাছাকাছি সংখ্যা পাওয়া যায়। এক মাইল বা প্রায় ১.৬ কিলোমিটারকে ইঞ্চিতে রূপান্তর করলে হয় ৬৩ হাজার ৩৬০ ইঞ্চি। অন্যদিকে এক আলোকবর্ষকে AU-তে রূপান্তর করলে হয় ৬৩ হাজার AU। এই মজার মিলটাই আলোকবর্ষের মাপকে আমাদের বোধগম্য মাপের কাছাকাছি নিয়ে আসে। সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বকে এক ইঞ্চির সঙ্গে তুলনা করলে এক আলোকবর্ষের দূরত্ব হবে এক মাইল বা ১.৬ কিলোমিটার। ফলে দুরত্ব মাপার ক্ষেত্রে এই হিসাব সহজ হয়। যেমন, আলফা সেন্টরাইয়ের দূরত্ব প্রায় ৪.৪ আলোকবর্ষ। এখন যদি সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বকে এক ইঞ্চি ধরি, তাহলে আলফা সেন্টুরাইয়ের দূরত্ব হবে ৪.৪ মাইল। এভাবে আরও চেনা কিছু নক্ষত্রের দূরত্বকে আমরা তুলনা করে দেখতে পারি। লুব্ধক (Sirius) নক্ষত্রের দূরত্ব হবে ৮.৬ মাইল, অভিজিৎ (Vega) নক্ষত্রের দূরত্ব হবে ২৫ মাইল, অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দূরত্ব হবে ২ কোটি ৮০ লাখ মাইল।
এতো ছোটো একক ইঞ্চির সাথে তুলনা করার পরও সংখ্যাগুলো অনেক বড় দেখা যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় আলোকবর্ষ আসলে কতটা বড়। এছাড়াও আলোকবর্ষকে আরো ছোট করে আলোকমিনিট (Light Minute) এবং আলোকসেকেন্ডেও (Light Second) রূপান্তর করা হয়। চাঁদ ও পৃথিবীর দুরত্বকে বলা হয় এক আলোকসেকেন্ড। কারণ চাঁদ থেকে কোন আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে আসতে প্রায় এক সেকেন্ড সময় লাগে।
তথ্যসূত্রঃ- প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment