এক সময়ে জাঁকজমক ছিল। ক্যাসিনো, স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা— সারাটা দিন ব্যস্ত থাকত দক্ষিণ আফ্রিকার নামিবিয়ার এক মরু শহর। আর আজ? রয়েছে সব কিছুই, কিন্তু অন্ধকারে। মানুষের পরিবর্তে ‘ভূত’ বিরাজ করছে এই শহরে। নামিবিয়ার এই মরু শহরের নাম কলমন্সকপ। কলমন্সকপের এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে একটা বড় ইতিহাস। ১৯০৮ সাল। নামিবিয়ায় তখন জার্মান আধিপত্য। জাচেরিয়াস লেওয়ালা নামে এক ব্যক্তি রেলওয়ে ট্রাক পরিষ্কার করছিলেন। রেলওয়ে ট্রাক থেকে বালি সরানোর সময়ই তাঁর চোখে পড়ে ছোট্ট পাথরের মতো বস্তুটি। সূর্যের আলোয় যা ঝলকে উঠছিল আরও। সেটা কী? কোনও ধারণা ছিল না জাচেরিয়াসের। তাঁর সুপারভাইজার, জার্মার রেলওয়ে ইনস্পেক্টর অগস্ট স্টাউচের হাতে তিনি সেটা দেন। একবার দেখেই চমকে ওঠেন অগস্ট। কোনও সাধারণ পাথর নয়, এতো হিরে! সেই সময়ে ততটা পরিচিতি ছিল না কলমন্সকপের। কিন্তু এই অঞ্চলে হিরের উপস্থিতি রাতারাতি বিখ্যাত করে তোলে কলমন্সকপকে। খনন কোম্পানিগুলো ডেরা ফেলতে শুরু করে। এর ৩-৪ বছরের মধ্যেই জার্মানরা জায়গাটিতে সাধারণের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করে। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় বার্লিনের একটি আকরিক খনন কোম্পানিকে। নিজেদের এলাকা ছেড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বাধ্য হন দূরে ঘাঁটি গাড়তে। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা কলমন্সকপ ক্রমে জনপ্রিয় মরু শহরে পরিণত হয়। সেখানে নানা রকম কারখানা গড়ে ওঠে। নতুন করে রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়। পোস্ট অফিস, বেকারি, স্কুল, এমনকি বিনোদনের জন্য ক্যাসিনোও গড়ে ওঠে।
কিন্তু কলমন্সকপের এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। যত বেশি খনন হতে থাকে তত দ্রুত হিরের পরিমাণ কমতে শুরু করে এই অঞ্চলে। ১৯২৮ সালে কলমন্সকপ থেকে মাত্র ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে অরেঞ্জ নদী তীরে নতুন একটি হিরের খনি আবিষ্কৃত হয়। মুখে মুখে সেই কথা প্রচারিত হয়ে যায়। কলমন্সকপকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলে মানুষ। জার্মান হিরে খনন সংস্থা, এমনকি এলাকার সাধারণ মানুষও নিজের জমি-জায়গা, জিনিসপত্র ছেড়ে দক্ষিণে যেতে শুরু করেন। ইতিহাসবিদরা জানান, ১৯৫৬ সাল নাগাদ কলমন্সকপ পুরোপুরি একটা পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হয়। ক্যাসিনো, স্কুল, পাওয়ার স্টেশন, কারখানা সব কিছু নিয়ে সারা বিশ্বের কাছেই আলোচিত হয়ে উঠেছিল শহরটা। ক্রমে সেখানে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। নিঃসঙ্গ শহরকে গ্রাস করে বালির ঝড়। বর্তমানে নামিবিয়ার এই পরিত্যক্ত শহর পর্যটনের জন্য জনপ্রিয়। প্রতিটা পরিত্যক্ত ঘরে কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও তারও বেশি বালির স্তূপ জমা হয়ে রয়েছে। সেই সব ছবি তুললেই ফোটোগ্রাফাররা ছুটে আসেন এই শহরে। প্রতি বছর ৩৫ হাজার পর্যটক আসেন। এককালের হিরের জন্য বিখ্যাত এই মরু শহর নতুন পরিচিতি পেয়েছে। কলমন্সকপ এখন নামিবিয়ার ‘ভুতুড়ে শহর’। এখানে হয়তো আর হিরের খোঁজ পাবেন না, কিন্তু খাঁ খাঁ বালির নিঃসঙ্গ পরিবেশে গা শিউরে উঠতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments:
Post a Comment