Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Tuesday, 29 November 2022

নদীয়ার নদ-নদী (River of Nadia)

'উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি/ দক্ষিণে দুরন্ত সাগর' -- 'নদীমাতৃক বঙ্গদেশ' কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্য। বঙ্গদেশে কত যে অজস্র নদ-নদী, খাল, খাঁড়ি, নালা, স্রোত-স্রোতিকা তার সুবিশাল জাল বিছিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এর কেউ তুষার গলা জলে নিত্যবহ, আবার কেউ নির্জীব নদী বর্ষার জলে উন্মত্ত, তো কেউ জোয়ারে পুষ্ট। সংখ্যার হিসেবে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের জেলা ২৩। প্রতিটি জেলা তার নদী-নালা সহ প্রাকৃতিক বৈচিত্রে পূর্ণ। আজকের প্রবন্ধের বিষয় হল নদীয়া জেলার নদী বৈচিত্র‍্য।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণবঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গাঙ্গেয় নিম্ন সমভূমি অঞ্চলের একটি জেলা হল নদীয়া, যার আয়তন ৩৯২৭ বর্গকিমি। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান নদীয়া জেলার নামকরণ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে বহু মতবাদ। কেউ বলেন নদীবহুল দেশ বলে নাম হয়েছে নদীয়া। কারও মতে নয়টি দ্বীপ বা নবদ্বীপ থেকে নদীয়া নামের উৎপত্তি। নবদ্বীপ নামে যে প্রাচীন নগরটি আছে, তার বর্তমান অবস্থান ভাগীরথীর পশ্চিম তটে। কথিত আছে অতীতে ভাগীরথী নাকি এখানে নয়টি দ্বীপ সৃষ্টি করে প্রবাহিত ছিল। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, অতীতে কোনো সাধু এখানে নয়টি দ্বীপ জেলে সাধনা করতেন। সেই নয় দিয়া বা দ্বীপ থেকে নবদ্বীপ বা নদীয়া নাম হয় স্থানটির। নামকরণে বিভিন্নতা থাকলে ও নদীয়া নদী বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। এ জেলার উল্লেখযোগ্য নদনদী গুলি হল -- ভাগীরথী-হুগলি, জলঙ্গি, চূর্ণী, মাথাভাঙ্গা, ইছামতী, ভৈরব প্রভৃতি।



★ ভাগীরথী-হুগলি ★ 

নদীয়া জেলার নদী পর্যালোচনাতে ভাগীরথী-হুগলি সর্বপ্রধান নদী, যা প্রকৃতপক্ষে গঙ্গা নদীরই অংশ। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে গঙ্গা দীর্ঘ প্রবাহপথ অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে গঙ্গা মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুরের মিঠিপুরের কাছে দুটি শাখায় বিভক্ত হয় এবং পূর্ব শাখাটির নাম হয় পদ্মা। আর অপর শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নামে বহু বাঁক নিয়ে দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মুর্শিদাবাদ থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত 'ভাগিরথী' এবং নবদ্বীপ থেকে মােহনা পর্যন্ত 'হুগলি' নদী নামে পরিচিত। মোহনা পর্যন্ত ভাগীরথী-হুগলি নদীটি আনুমানিক ৫৬০ কিমি দীর্ঘ। জলঙ্গীর সঙ্গম বা নবদ্বীপ থেকে সাগর পর্যন্ত ভাগীরথীর অংশ টুকুর (৩২০ কিমি) ইংরেজরা নাম দিয়েছিল হুগলী নদী। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সমগ্ৰ নদীটিই  গঙ্গা নামে পরিচিত। ভূবিদদের মতানুসারে ভাগীরথী না পদ্মা কোনটি গঙ্গার মূল স্রোত তা নিয়ে তর্কবিতর্ক আছে। বলা হয় ভাগীরথীর পথ অতীতে পরিবর্তন হয়েছে। ভাগীরথী এক সময় দক্ষিনে নেমে রূপনারায়নে জল দিত। পরে নদীটি পূর্বে সরে যায় এবং ত্রিবেণীতে এসে দুটি শাখা ছড়ায়। অতীতে বেশ কিছু কাল পশ্চিম শাখা সরস্বতী মুখ্য স্রোতপথ হয়ে উঠে আবার কোনসময়ে পূর্ব শাখা যমুনা বেগবতী হয়ে উঠে। পরে এই শাখা দুটি নানা কারণে মজে আসে ও মধ্যমধারা হুগলী নদী হয়ে ওঠে ভাগীরথীর মুখ্য পথ।


★ জলঙ্গি নদী ★ 

মুর্শিদাবাদ জেলার পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে জলঙ্গি নদীয়া ছেড়ে পলাশীপাড়া, তেহট্ট, কৃষ্ণনগর শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে বেঁকে মায়াপুরের কাছে ভাগীরথীতে পড়েছে। এটি গঙ্গা-পদ্মার শাখানদী, আবার ভাগীরথী-হুগলির উপনদীও বটে। জলঙ্গি নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২২০ কিমি। এই নদীকে আমরা খুঁজে পাই 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে গাঙ্গিনী রূপে। তবে বর্তমানে এই জলঙ্গি বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় নির্জীব অবস্থায় থাকে। নদীটির প্রবাহ পথে প্রচুর নদী বাঁক ও অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়। নদীটির অপর নাম জলাঙ্গি। জলঙ্গি পশ্চিমবঙ্গের এক মাত্র নদী যার হয়তো ডাকনাম আছে। কৃষ্ণনগর ও সন্নিহিত অঞ্চলের আদিবাসীরাদের কাছে জলঙ্গি নদী 'খড়ে' নামে পরিচিত। 


★ মাথাভাঙা ★ 

মাথাভাঙা নদীর উৎস হল পদ্মা নদী। এক সময় এ নদী খুব স্রোতস্বিনী ছিল। বহু জনপদ গ্রাস করে মানুষের মাথা ভেঙে দিয়েছিল বলে এর নাম হয়েছে মাথাভাঙা। মতান্তরে, উৎসমুখে মূল নদী পদ্মার সঙ্গে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙে যাওয়ায় এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। তবে কোনো এক সময় এ নদীটি হাউলিয়া বা হাউলি নামে পরিচিত ছিল। মোট দৈর্ঘ্য ১২১ কিমি। মাথাভাঙ্গা নদী নদীয়া জেলার মাঝদিয়ার কাছে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে তার নাম হারিয়েছে। এর দক্ষিন পশ্চিম শাখাটির নাম হয় চূর্ণী এবং অন্য অংশটির নাম ইছামতী।


★ চূর্ণী ★ 

চূর্ণী নদীটির দৈর্ঘ্য ৫৬ কিমি। এই নদীটি নদীয়া জেলার মাজদিয়া মাথাভাঙ্গা নদী থাকে উৎপন্ন হয়েছে। চূর্ণী নদীটি মাজদিয়া, শিবনিবাস, হাঁসখালি, বীরনগর, রানাঘাট হয়ে চাকদাহের কাছে গিয়ে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পড়েছে। কয়েক শতাব্দী আগেও চূর্ণী নদীর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বলা হয়, নদীয়ারাজের ইচ্ছেতে কৃষ্ণগঞ্জ থেকে শিবনিবাস পর্যন্ত একটি খাল কেটে মাথাভাঙ্গার সাথে যুক্ত করা হয়। বর্গির উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য এই শিবনিবাসকে  বেড় দিয়ে খাল কেটে অঞ্জনা নদীর সাথে যুক্ত করা হয়।অতীতে এই অঞ্জনা জলঙ্গী থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগর বাদকুল্লা হয়ে ভাগীরথী-হুগলি নদীতে পড়েছিল। যাত্রাপুরের কাছে অঞ্জনা থেকে একটি শাখা বেরিয়ে ইছামতীতে পড়ে। মাথাভাঙার জল পেয়ে অঞ্জনা ও কাটা খালটি (চূর্ণী) প্রবল হয়ে ওঠে। শোনা যায় এক সময়ে কোন কারন বশত অঞ্জনার শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কাটা খালটি ক্রমে বড় হয়ে চূর্ণী নামে প্রবাহিত হয়। বর্তমানে এই নদীটি মজে গিয়ে প্রায় জলশূন্য। তবে বর্ষার জলে দু-কূল প্লাবিত হয়।


★ ইছামতী ★ 

নদীয়া জেলার আর একটি উল্লেখযোগ্য নদী হল ইছামতী। দৈর্ঘ্য ৫৫ কিমি। নদীটি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমানা ধরে প্রবাহিত। নদীয়া জেলার মাজদিয়ার কাছে মাথাভাঙা নদী দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুটি নদী --  ইছামতী ও চূর্ণী উৎ‌পন্ন করে। পূর্ব শাখাটি ইছামতী নামে ভারতে প্রায় ২০ কিমি তীর্যকভাবে প্রবাহিত হয়ে মুবারকপুরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এটি বাংলাদেশে আবারো ভারতে প্রবেশ করে নদীয়ার দত্তফুলিয়া দিয়ে। নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমারেখা তৈরি করেছে, যা আংড়াইল থেকে কালাঞ্চি এবং পুনরায় গোয়ালপাড়া থেকে কালিন্দী-রায়মঙ্গল রূপে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। নদীটির নিচের অংশে জোয়ার ভাটার প্রভাব লক্ষ‍্য করা যায়। পলি জমার কারণে গ্রীষ্মকালে নদীতে জল থাকে না বললেই চলে। কিন্তু বর্ষাকালে প্রায়শই বন্যা এই নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।


★ ভৈরব ★ 

লিঙ্গ বিচারে ভৈরব নদীর বদলে নদ হিসাবে পরিচিত।গঙ্গার শাখানদী ভৈরব বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার টেংরামারি বর্ডার অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে যশোরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দৈর্ঘ্য ১৬০ কিমি। ভৈরব মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নদীয়ার আঁধারকোটা করিমপুর হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেখানে মাথাভাঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে দক্ষিন-পূর্বে নেমেছে। এর উত্তর অংশ পশ্চিমবঙ্গে আর বাকি অংশ বাংলাদেশ দিয়ে প্রবাহিত।


★ অঞ্জনা ★ 

সপ্তদশ শতকে জলঙ্গির একটি শাখা অঞ্জনা নামে কৃষ্ণনগরের কাছ থেকে বেরিয়ে দোগাছিতে দু’টি ধারায় বিভক্ত হত। উত্তরের শাখাটি চিত্রশালী হয়ে হাঁসখালিতে চুর্ণিতে মিশত। যেটি হেলের খাল নামে পরিচিত। দক্ষিণ শাখাটি জয়পুর, ধর্মদহ, বাদকুল্লা, চন্দনদহ হয়ে ব্যাসপুরের কাছে চুর্ণিতে মিশেছে। দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত (১৮৫৭) বইতে অঞ্জনার কথা পাওয়া যায় বিশদ ভাবে। কল্যাণ রুদ্রের মতে, ১৬৮৪ সালে রাজা রুদ্র রায় নদীর উৎসমুখটি বন্ধ করে দেওয়ার পরে নদীটি মজে যায়।


নদীয়া জেলার অন্যান্য ছোটোবড়ো নদনদী গুলি হল -- গড়াই, যমুনা, গুড়গুড়িয়া, পাগলাচন্ডী প্রভৃতি। অসংখ্য ছোট ছোট বহু নদী-খাল এই জেলাতে দেখা যায়। এদের বেশিরভাগই আজ মজে গিয়ে  মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে।


তথ্যসূত্রঃ- 

পশ্চিমবঙ্গের নদনদী - অশোক কুমার বসু ;

আনন্দবাজার পত্রিকা ;

Wikipedia. 

No comments:

Post a Comment