নিজের দেশ, নিজের জন্মভূমি সম্পর্কে কার না জানতে ইচ্ছা করে। গঙ্গা বিধৌত অববাহিকায অবস্থিত ঘোড়ালিয়া। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার রানাঘাট মহকুমার শান্তিপুর সিডি ব্লকের একটি গ্রাম। বর্তমানে এটি একটি আদমশুমারি শহর বা সেন্সাস টাউন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ঘোড়ালিয়া গ্রামের অবস্থান কোড বা গ্রাম কোড হল ৩২১৯৮১। ঘোড়ালিয়া গ্রামের নিকটতম শহর শান্তিপুর।
অবস্থান:
ঘোড়ালিয়া পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাট মহকুমার শান্তিপুর সিডি ব্লকের একটি আদমশুমারি শহর বা Census Town। এর ভৌগোলিক অবস্থান হল 23.2433 ° উত্তর 88.4587 ° পূর্ব। জেলা আদমশুমারি হ্যান্ডবুক ২০১১ নদীয়াতে, শান্তিপুর সিডি ব্লকের মানচিত্রে ঘোড়ালিয়া-কে শান্তিপুর এবং ফুলিয়ার মধ্যবর্তী আদমশুমারি শহর হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আয়তন ও বিস্তৃতি:
২০১১আদমশুমারি অনুযায়ী, ঘোড়ালিয়ার মোট আয়তন ১.৯৫০৮ বর্গকিলোমিটার বা ০.৭৫৩২ বর্গমাইল।
নামকরণ:
বক্তিযার খিলজী এই স্থানে ঘোড়া রেখেছিলেন বলে এই স্থানের নাম হয় ঘোড়ালিয়া।
সীমা ও প্রতিবেশী গ্রাম:
পূর্বে চাঁপাতলা, পশ্চিমে শান্তিপুর শহর, উত্তরে বাথনা, দক্ষিণে বিহারিয়া, নরসিংহনগর, ছেরা চর কৃষ্ণবাটি ।
ঘোরালিয়ার নিকটবর্তী গ্রাম গুলি হল বাথনা (Bathna), বিহারিয়া (Beharia), চাঁপাতলা (Champaklata), নরসিংহনগর (Narasinghanagar), ছেরা চর কৃষ্ণবাটি (Chhera Char Krishnabati), নৃসিংহপুর (Nrisinghapur), হরিনদীবাঁশতলা (Harinadibhastsala),
ফুলিয়া (Phulia), দুর্গাপুর (Durgapur), পালিতপাড়া (Palitpara), দোহারপাড় (Doharpar)।
ভূপ্রাকৃতি ও মৃত্তিকা:
এটি নদীবিধৌত সমভূমি অঞল। এখানে প্রচুর পরিমাণে পলি মৃত্তিকা দেখা যায়। পলিমাটি চাষের পক্ষে খুব ভালো। এছাড়া এঁটেল ও দোয়াশ মাটি দেখা যার।
নদ-নদী:
অঞ্চলটির মধ্যে দিয়ে কোন নদী প্রবাহিত হয়নি। তবে ঘোড়ালিয়ার (সিটি) দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গঙ্গা নদী। পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরধুনী নদী। যা আজ মৃত। বর্ষাকালে গঙ্গার জল বৃদ্ধি পেলে তখন তা সুরধুনী নদীতে প্রবাহিত হয়। বাকি সময় জল থাকে না । তখন নদীবক্ষে চাষ আবাদ হয়।
আবহাওয়া ও জলবায়ু:
বায়ু প্রবাহ, বায়ুর উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাতের তারতম্যের জন্য এখানকার আবহাওয়ার নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতির। এখানে গ্রীষ্ম ও শীত দুটি বিপরীত ঋতু দেখা যায়। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘস্থাযী কিন্তু শীতকাল স্বল্পস্থাযী। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টিপাত হয়। এখানে ঊষ্ণ মৌসুমী জলবায়ু বিরাজ করে।
ঋতুবৈচিত্র্য:
তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার পার্থক্যের জন্য চারটি ঋতুতে ভাগ করা যায় - গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত। এছাড়াও দুটি ঋতু শরতের পর হেমন্ত এবং শীতের পর বসন্ত দেখা যায়। কিন্তু এই দুই ঋতু খুবই স্বল্পকালীন। এদের প্রভাব তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
গ্রীষ্মকাল: মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল। এ সময়ের গড় উষ্ণতা ৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস।মার্চ, এপ্রিল ও মে এই তিন মাসের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এই সময়ে আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার থাকে। মার্চ মাসে দিনের তাপমাত্রা 33 ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং রাতের তাপমাত্রা 21 ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়।
এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। মে মাসে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬° ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬° ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়।
গ্রীষ্মকালের শেষের দিকে এপ্রিল-মে মাসে বিকেলের দিকে ঝড় ও বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হয়, একে কালবৈশাখী বলে।
বর্ষাকাল: সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল। এই সময়ে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ২৩.২৩ সেমি। জুন মাসে ২১.১ সেমি, জুলাই মাসে ২৫.২৮ সেমি, আগস্ট মাসে ২৪.৬৭ সেমি ও সেপ্টেম্বর মাসে ২১.৩৬ সেমি বৃষ্টিপাত হয়।
শরৎকাল: অক্টোবর - নভেম্বর দুমাস শরৎকাল এই সমর উষ্ণতা কমতে থাকে। উত্তাপ কমে যাওয়ার ফলে রাত্রিতে একটু শীতের ভাব থাকে এবং ভোরের দিকে শিশির পড়ে। এই সময়টা খুবই আরামদায়ক। মাঝে মধ্যে আশ্বিনের ঝড়ের উপদ্রব ঘটে।
শীতকাল: ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস শীতকাল। নভেম্বরের শেষের দিকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এই সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে দিনের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং রাতের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয়। জানুয়ারিতে দিনের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়।
ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে-ফেব্রুয়ারি মাসে আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার। সামগ্রিক জলবায়ু খুবই মনোরম। সামগ্রিক আবহাওয়া পর্যালোচনা দেখায় এই সময় হল বছরের অন্যতম সেরা সময়।
(পশ্চিমবঙ্গে ৬টি ঋতু বিদ্যমান। তবে বর্তমানে ৫ টি ঋতুর প্রভাব দেখা গেলও হেমন্ত ঋতুর দেখা মেলে না।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল।আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস মিলে বর্ষাকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎকাল। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্তকাল। পৌষ ও মাঘ - এই দুই মাস মিলে শীতকাল গঠিত। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস মিলে বসন্ত কাল।)
জনসংখ্যা:
২০১১ সালের ভারতের আদমশুমারি (জনগণনা) অনুসারে, ঘোড়ালিয়ার মোট জনসংখ্যা ৫,২৬৮ জন, যার মধ্যে ২,৭৭৬ জন (৫৩%) পুরুষ এবং ২,৪৯২ (৪৭%) মহিলা। মহিলা লিঙ্গ অনুপাত ৮৯৮ (পশ্চিমবঙ্গে ৯৫০) যা রাজ্যের তুলনায় কম। ০-৬ বছর বয়সের মধ্যে জনসংখ্যা ৪৪১ জন, মোট জনসংখ্যার ৮.৩৭%। শিশু লিঙ্গ অনুপাত ৯৭৮ (পশ্চিমবঙ্গে ৯৫৬) যা রাজ্যের তুলনায় বেশি।
অঞ্চলটির জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৭০০ জন।
ঘোড়ালিয়া (সিটি) এর বেশিরভাগ মানুষ তফসিলি জাতির (এসসি)। তফসিলি জাতির (SC) মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৭.৪৬ % এবং তফসিলি উপজাতির (ST) মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ০.৯৩ %।
এখানে মোট জনসংখ্যার ৯৯.৮৫% হিন্দু, ০.০৯% মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করেন। বাকি ০.০৬% মানুষের কোন ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়নি (আদমশুমারি ২০১১ এর তথ্যানুসারে)।
শিক্ষা: এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা বেশ উন্নত। প্রতি পাড়তে একটি করে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র আছে। গ্রামে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ-প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ফুলিয়া ও শান্তিপুরে অনেক গুলি মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে এবং শান্তিপুরে একটি মহাবিদ্যালয় আছে। যা এই অঞ্চলের শিক্ষার মানকে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে শিক্ষার হার ৭৭.৪৮% (পশ্চিমবঙ্গে ৭৬.২৬%) যা রাজ্যের শিক্ষার হারের তুলনায় বেশি। পুরুষের শিক্ষার হার ৮১.৬৭% এবং মহিলাদের শিক্ষার হার ৭২.৮৭%।
স্বাস্থ্য: চিকিৎসার জন্য গ্রামে একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরেও পরিষেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী ফুলিয়াতে একটি গ্রামীন হাসপাতাল ও শান্তিপুরে স্টেট জেনারেল হাসপাতাল আছে।
জীবিকা:
কৃষি কাজ, কৃষিকাজের জন্য মজুর, শিল্পের কাজ, চাকুরী, মাছধরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চালানো, পশুপালন এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা। এছাড়া জাতিগত কাজ যেমন - নাপিত, কামার, কুমোর, ছুতোর, মুচি, গয়লা, তাঁতী প্রভৃতি কাজেও অনেক লোক নিয়োজিত রয়েছে। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২,৩৬৩ জন ব্যবসায়িক কাজে নিযুক্ত আছে। এর মধ্যে ১,৭৫৮ জন পুরুষ এবং ৬০৫ জন মহিলা। বাকি কর্মক্ষম মানুষ চাকরি, সেবা এবং চাষাবাদ এবং শ্রমের কাজ করেন।
কৃষি: ধান, পাট, শাক-সবজি ও বিভিন্ন রকম ফলের চাষ হয়ে থাকে। ফলের মধ্যে আমের চাষ বেশি পরিলক্ষিত হয়।
পশুপালন: বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করে থাকেন। বর্তমানে কিছু মানুষ মাংস উৎপাদনের জন্য খামারে মুরগি পালন করছেন।
শিল্প: তাঁত হল এখানকার প্রধান শিল্প। এটি একটি কুটির শিল্প। প্রচুর মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। 88.62 % মূল কাজে নিযুক্ত এবং 11.38 % প্রান্তিক কাজে নিযুক্ত।
উদ্ভিদ:
সাধারণত চিরসবুজ প্রকৃতির উদ্ভিদ দেখা যায়। এখানকার প্রধান প্রধান উদ্ভিদগুলো হল আম, জাম, কাঠাল, পেয়ারা, লিচু, নারকেল, সুপারি ও তাল। এখানে প্রচুর পরিমাণে আম ও লিচুর বাগান লক্ষ্য করা যায়।
পরিবহণ ও যোগাযোগ:
সড়ক পথে জাতীয়সড়ক ১২ (পূর্বতন NH34) এর মাধ্যমে কোলকাতা ও শিলিগুড়ির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। রেলপথে পূর্ব-রেলের মাধ্যমে কোলকাতার সঙ্গে যুক্ত। পূর্ব-রেলের শিয়ালদহ - শান্তিপুর শাখায় বাথনা কৃত্তিবাস রেলওয়ে হল্ট স্টেশনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা হয়। গ্রামে একটি ভারতীয় ডাক বিভাগের শাখা অফিসের মাধ্যমে চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়ে থাকে।
নাগরিক পরিষেবা
ঘোড়ালিয়া সেন্সাস টাউন প্রশাসন ১৩০৬ টি বাড়িতে সুরক্ষিত পানীয় জল সরবরাহ করে। উল্লেখযোগ্য নাগরিক সুবিধার মধ্যে রয়েছে রাস্তা, খোলা ড্রেন, সুরক্ষিত জল সরবরাহের সাথে হ্যান্ড পাম্প, নলকূপ, বোরওয়েল এর মতো মৌলিক সুবিধা প্রদান করে। বর্তমানে ৫২৩ টি বাড়িতে ঘরোয়া (Domestic) বৈদ্যুতিক সংযোগ আছে। চিকিৎসা সুবিধার মধ্যে ১ টি প্রসূতি ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ১ টি মোবাইল স্বাস্থ্য ক্লিনিক আছে। শিক্ষাগত সুবিধার মধ্যে আছে ২ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১ টি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া ১ টি বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাংক, 1 টি কৃষি সমবায় সমিতির শাখা ব্যাঙ্ক, একটি বেসরকারী ব্যাংক এর এ টি এম, ভারতীয় ডাক বিভাগের একটি শাখা অফিস আছে। ছোটদের জন্য এটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে পঞ্চায়েত এর মাধ্যমে। এছাড়াও আছে একটি বড়ো খেলার মাঠ। ঘোড়ালিয়া সেন্সাস টাউনের মোট প্রশাসন সেন্সাস টাউনের সীমানার মধ্যে রাস্তা নির্মাণ এবং এর আওতাধীন সম্পত্তির উপর কর আরোপ করে।
*এক নজরে*
স্থানাঙ্ক: 23.2433 ° N 88.4587 ° E
দেশ: ভারত
রাজ্য: পশ্চিমবঙ্গ
জেলা: নদীয়া
আয়তন: 1.9508 বর্গ র্কিমি (0.7532 বর্গ মাইল)
জনসংখ্যা (2011): 5,268 জন
জনসংখ্যার ঘনত্ব: 2,700/
বর্গ কিমি (7,000/বর্গ মাইল)
সরকারী ভাষা: বাংলা, ইংরেজি
সময় অঞ্চল: UTC+5: 30(IST)
পিন: 741404
টেলিফোন/এসটিডি কোড: 03454
লোকসভা কেন্দ্র: রানাঘাট
বিধানসভা কেন্দ্র: শান্তিপুর
ওয়েবসাইট: nadia.gov.in
তথ্যসূত্র:
1. https://en.m.wikipedia.org
2. https://villageinfo.in
3. Census report (https://www.census2011.co.in)
4. https://www.holidaytravelreports.com
5. শান্তিপুর প্রসঙ্গ ১ম খণ্ড - কল্যাণী নাগ
6. Google Maps
No comments:
Post a Comment