এলিয়েন শব্দটি শোনা মাত্রই আমাদের মস্তিষ্কে ভাসে আজব সব চিত্র। যা আমাদের পৃথিবীর সাধারণ সব চিত্র থেকে একেবারে ভিন্ন। এই জায়গাটির গাছ-পালা পশু পাখি সব কিছুই আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরের মতো।এমন আজব বা রহস্যময় একটি জায়গার নাম সোকোত্রা দ্বীপ।
সোকোত্রা আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত। ভৌগোলিক পরিবেশ এবং গাছপালার অদ্ভুত দর্শনের কারণে এই দ্বীপকে ভিনগ্রহবাসীদের দ্বীপ বা ‘এলিয়েন দ্বীপ’ বলা হয়ে থাকে। দ্বীপ বললে ভুল বলা হবে, কেননা সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ আরব সাগরের চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলোর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে ইয়েমেনের ভেতরে।
মধ্য প্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপপুঞ্জ। সোকোত্রাই আয়তনে সবচেয়ে বড়। সুকাত্ররর আয়তন প্রায় ৬৫৬০ বর্গকিলোমিটার। ইয়েমেন ২০১৩ সালে এটিকে একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে। এটা হর্ন অফ আফ্রিকা থেকে ২৪০ কিলোমিটার (১৫০ মাইল) পূর্ব এবং আরব উপদ্বীপ থেকে ৩৮০ কিলোমিটার (২৪০ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। এর স্থানাঙ্ক ১২°৩০′৩৬″ উত্তর ৫৩°৫৫′১২″ পূর্ব। ৩,৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার ভূমি বিশিষ্ট এ দ্বীপপুঞ্জ দৈর্ঘ্যে ১৩২ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৫০ কিলোমিটার। প্রদেশটির রাজধানীর নাম হাদিবু।
আজব বা রহস্যময় দ্বীপ সোকোত্রা। এখানে তেমন কোনো আজব ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি, তবে দ্বীপটি নিজেই যেন অপার্থিব রহস্যে ভরপুর। এখানকার জীবজগৎ, প্রাণীকুল কোন কিছুর সাথেই পৃথিবীর অন্য কোন স্থানের কোনো মিল নেই। যেমন অদ্ভুত দর্শনের গাছপালা এখানে, তেমনিই অদ্ভুত এখানকার পশুপাখি। এখানকার সবকিছু এত অদ্ভূত দর্শনের যে এই দ্বীপকে ভিনগ্রহের কোনো জায়গা বললে মোটেই ভুল হবে না। আরব সাগরের মাঝে অবস্থিত এই দ্বীপ যেখানে এলিয়েনদের দেখা না মিললেও ভৌগোলিক পরিবেশ এবং গাছপালার ভিন্নতার জন্যই নাম হয়েছে “এলিয়েন দ্বীপ”।
ভৌগলিকভাবে দ্বীপটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সারাবছরই এখানে হালকা বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালে এই বৃষ্টিপাতের পরিমান বেড়ে যায়। সারাবছরই দ্বীপের তাপমাত্রা মোটামুটি স্থিতিশীল। গ্রীষ্ম, বর্ষা কিংবা শীত যেকোনও সময় এখানে এলে দেখা যাবে একধরনের কুয়াশা সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাজুড়ে সবসময় এক কুহেলিকার আবরণ তৈরি করে রেখেছে।
এ দ্বীপের বেশিরভাগ উদ্ভিদই স্থানীয়। এ দ্বীপের বেশিরভাগ উদ্ভিদই এন্ডেমিক। পৃথিবীর কোথাও এগুলোর দেখা মেলে না। এই স্থানীয় উদ্ভিদগুলো গড়ন এতটাই অদ্ভুত যে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না।
উদ্ভিদগুলোর অদ্ভুত গড়নই এই দ্বীপকে ভিনগ্রহীদের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করার মূল কারণ। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের জীববিজ্ঞানীগণ জরিপ করে প্রায় ৭০০ প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ পেয়েছেন সারা পৃথিবীতে। আর সোকোত্রা দ্বীপে ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩০৭টি প্রজাতিই স্থানীয়, অর্থাৎ প্রায় ৩৭ শতাংশ উদ্ভিদ আপনি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাবেন না। ২০০৪ সালে IUCN এর লাল তালিকায় সোকোত্রার ৩টি অতিবিপন্ন এবং ২৭টি বিপন্ন উদ্ভিদের নাম রয়েছে।
এই দ্বীপের সবচেয়ে অদ্ভুত গাছ হলো ড্রাগন-ব্লাড ট্রি। এই গাছটি দেখতে একেবারে ব্যাঙের ছাতার মতো। উচ্চতায় বড়জোড় ৭-৮ ফুট। অদ্ভুত গড়নের ছাতাকৃতির এই গাছটি থেকে লাল বর্ণের আঠালো পদার্থ বের হয়। কথিত আছে বহুকাল আগের ড্রাগনের রক্ত থেকে এই গাছের উৎপত্তি এবং সে অনুযায়ী এর নামকরণ! এই গাছের আঠা রঙ তৈরিতে এবং বার্নিশের কাজে ব্যবহৃত হয়।
আরেকটি বিশেষ উদ্ভিদ হলো ডেন্ড্রোসসিয়াস নামক এক প্রকারের শশা গাছ। বিভিন্ন আকৃতির কান্ডটি লম্বা হয়ে চূড়া তৈরি করে, যেখানে হলুদ, গোলাপী ফুল ফোটে। উভলিঙ্গ এই গাছের জন্ম এই দ্বীপের বয়সের দ্বিগুণ আগে বলে গবেষকদের ধারণা। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এদের বংশবিস্তারের অনুকূল।
এছাড়াও রয়েছে পোমেগ্র্যানেট নামক ফুলের উদ্ভিদ। এটি আড়াই থেকে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সাধারণত ফুল এবং ফল হয়। ফুলগুলো সাধারণত গোলাপি বা লালের কাছাকাছি রঙের হয় আর ফল পাকলে তা হলদে-সবুজ রঙ ধারণ করে। এই গাছের কাঠ খুব শক্ত হয় এবং ছোটখাট আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃতও হয়। এই গাছটি সোকোত্রার বিশেষ উদ্ভিদ হলেও হাওয়াইতে দ্বীপে চাষের চেষ্টা চলছে।
এমন অদ্ভুত দেখতে গাছ খুব একটা চোখে পড়েছে কি? আরব সাগরের বুকে একটি দ্বীপে এমন আরও অনেক বিচিত্র দর্শন গাছ রয়েছে যেগুলিকে দেখলে সত্যজিৎ রায়ের লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলির কথা মনে পড়ে যেতে পারে। প্রফেসর শঙ্কুর নানা অভিযানের মধ্যে এমন অনেক বিচিত্র গাছের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এই দ্বীপে এলে কল্পবিজ্ঞানের গল্পের বিচিত্র দর্শন গাছপালা চোখের সামনে দেখতে পাবেন।
২০০৮ সালে ইউনেসকো এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর তকমা দেয়। এই সোকোত্রা দ্বীপের বিচিত্র দর্শন গাছপালাগুলির মধ্যে অন্যতম হল ড্রাগন-ব্লাড, ডেন্ড্রোসসিয়াস, পোমেগ্র্যানট। এই দ্বীপে এলে চারপাশের পরিবেশ আর গাছপালা দেখে আপনার মনে হতেই পারে যে, আপনি হয়তো অন্য কোনও গ্রহে এসে পড়েছেন!
স্কিংস, পা-বিহীন টিকটিকি, নানা প্রকারের মাকড়শা এবং তিন প্রকারের কাঁকড়ার দেখা মেলে এ দ্বীপে। স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে মানুষ ও বাদুড় ছাড়া আর কোনো প্রাণীর সন্ধান মেলেনি।
দ্বীপটি তেমন জনবহুল নয়। সোকোত্রায় বর্তমানে ছশোটি গ্রামে প্রায় ষাট হাজার মানুষ বসবাস করে। দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী হাবিদু শহরেই সবচেয়ে বেশি লোক বাস করে। দ্বীপে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকই স্থানীয়।
কি ভাবছেন ? একবার ঘুরে দেখবেন নাকি, এই "এলিয়েন দ্বীপ সোকোত্রা"। চাইলে আপনি যেতেই পারেন জাহাজে করে আরব সাগর দিয়ে তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস বাদে বছরের অন্যান্য সময়ে। অথবা বিমানে সোকোত্রা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এখানে গণপরিবহন ব্যবস্থা খুবই সামান্য। দুই-একটি মিনিবাসের দেখা মিলতে পারে। তাছাড়া আপনি চাইলে গাড়িও ভাড়া করতে পারেন। পরিবহন ব্যবস্থা নগণ্য হবার প্রধান কারণ এই এলাকার বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম। গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহারে খুব বাজেভাবে ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় হয়তো আপনাকে পায়ে হেঁটেই চলতে হতে পারে।
তথ্যসূত্র:
Wikipedia, goggles.blog, আটপৌরে, Roarmedia, Zee24Ghanta, DurbinNews.
লেখক:
অয়ন বিশ্বাস
ঘোড়ালিয়া,শান্তিপুর,নদিয়া।