Welcome to GEO HUB (Enhance Your Geo Knowledge) Ghoralia, Santipur, Nadia, West Bengal-741404, Mobile: 8926495022 email: geohubghoralia@gmail.com

Diable copy paste

Wednesday 9 August 2023

মেদিনীপুরের গোপগড় ইকোপার্ক (Gopegarh Heritage & Nature Eco-tourism Centre)

ইরেজি শব্দ ইকোলজিক্যাল পার্ক (Ecological Park) অর্থাৎ বাস্তুসংস্থানগত উদ্যানের সংক্ষিপ্ত রূপ হল ইকোপার্ক (Eco Park)। ইকোপার্ক হল ইন-সিটু সংরক্ষণ ব্যবস্থার অন্তর্গত একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশযুক্ত স্থান, যেখানে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়। ইকোপার্ক সাধারণ মানুষকে প্রকৃতিকেন্দ্রিক বিনোদন প্রদান করে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের পথ প্রশস্ত করে। তাই, প্রাকৃতিক পর্যটনে ইকোপার্ক গুরত্বপূর্ণ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপগড় ইকোপার্ক তেমনই একটি ইকোপার্ক, যা মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ৪.৫-৫ কিমি দূরে কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত। কঙ্কাবতী গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গোপগড় ইকোপার্কের আয়তন প্রায় ৪ বর্গকিমি (৪০ হেক্টর)। পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের উদ্যোগে ২০০০ সালের ২০ শে ডিসেম্বর গোপগড় ইকোপার্কের উদ্বোধন হয়। পরবর্তীতে, ২০০৬ সালের ১৫ ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন গোপগড় ও গোপ প্যালেসকে 'হেরিটেজ সাইট' হিসেবে ঘোষণা করে এবং নামকরণ করা হয় 'গোপগড় হেরিটেজ ও নেচার ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার' (Gopegarh Heritage & Nature Eco-tourism Centre)। 



গোপগড়কে নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক কাহিনী ও কিংবদন্তী রয়েছে। গোপগড় একটি ঐতিহাসিক স্থান, যার সাক্ষী হল গোপগড় হেরিটেজ হাউস সহ বিভিন্ন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ। অনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম শতকে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের যুগে গোপগড় নির্মিত হয়েছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, মহাভারতের মৎস্য রাজ্যের অধিপতি বিরাট রাজার গোশালার অংশবিশেষ 'দক্ষিণ গোপগৃহ' হল আজকের গোপগড়। ধারণা করা হয়, গোপদের বিশ্রামগার 'গোপগৃহ' থেকেই 'গোপগড়' নামটি এসেছে। উল্লেখ্য, মহাভারতের কাহিনী অনুসারে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা মৎস্য রাজ্যে বিরাট রাজার আশ্রয়ে ছিলেন। যদিও, বিরাটনগর সহ মৎস্য রাজ্য বর্তমানে রাজস্থানে অবস্থিত। হয়তো অতীতে মহাভারতের কাহিনীর সাথে জড়িয়ে গোপগড়কে মহিমান্বিত করা হয়েছে। তবে অতীতে মেদিনীপুর এলাকা কোটদেশ (বর্তমানে ওড়িশার গড়জাত অঞ্চল) -এর অন্তর্গত ছিল এবং কোটদেশ অধিপতি বিরাট রাজার উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ কালেক্টর এল. এস. এস. ও'ম্যালি 'Bengal Districts Gazetteers Midnapore' (১৯১১)-তে উল্লেখ করেছেন যে, আইন-ই-আকবরীতে মেদিনীপুরকে জলেশ্বর সরকারের একটি বড়ো নগর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে ; যেখানে দুটি দুর্গ রয়েছে, একটি প্রাচীন ও অন্যটি নতুন। ওই প্রাচীন দুর্গটিই সম্ভবত গোপগড়। তবে, মেদিনীপুরের ইতিহাস গবেষক চিন্ময় দাশের মতে, জনশ্রুতি, প্রায় পাঁচশো-ছ’শো বছর আগে ওড়িশার রায়বনিয়া গড়ের রাজা বিরাটগুহ মেদিনীপুরে উঁচু টিলার উপর একটি দুর্গ তৈরি করেছিলেন। সেটিই পরে গোপগড় নামে পরিচিত হয়। যদিও সেই দুর্গের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই। 


বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে গোপগড় ইকোপার্কের প্রদর্শন ফলক থেকে জানা যায়, কংসাবতী নদী তীরবর্তী গোপগড় হল ল্যাটেরাইট সমন্বিত, চ্যাপ্টা মস্তকবিশিষ্ট উচ্চভূমি। এই উচ্চভূমির প্রান্তদেশ খুবই খাড়া এবং ছোট ছোট নালি (Rill) এবং খাত (Gully) দ্বারা ব্যবচ্ছিন্ন। প্রাচীন পলিগঠিত এই উচ্চভূমি ক্ষয় প্রতিরোধ করে কংসাবতী নদীর প্লাবনভূমি থেকে প্রায় ২৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে। গোপগড়ে কোয়াটারনারি যুগের পাললিক শিলার ওপর ল্যাটেরাইট সমতলীকরণ তল গড়ে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গোপগড়ের উচ্চতা ৬৪.৩০ মিটার (২১১ ফুট)। এই অঞ্চলের বার্ষিক সর্বোচ্চ উষ্ণতা (গড়) ৩৬.৫° C ও বার্ষিক সর্বনিম্ন উষ্ণতা ১৩° C এবং গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫৬ সেমি। গোপগড় ইকোপার্কে মূলত পর্ণমোচী অরণ্য দেখা যায়। এই অঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদগুলি হল : নিম, বকুল, সোনাঝুরি, পলাশ, সেগুন, কাজুবাদাম, ইউক্যালিপটাস, কুসুম, ছাতিম, শাল ইত্যাদি। গোপগড় ইকোপার্কের 'জীববৈচিত্র্য বৃক্ষ' ফলক থেকে জানা যায়, এখানে ৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩০ প্রজাতির প্রজাপতি ও ৬১ প্রজাতির পাখি রয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রজাপতি প্রজাতিগুলি হল : গ্রাস ইয়েলো, টনি কোস্টার, লাইম সোয়ালোটেইল্, মরমন, কমন টাইগার, লেমন এমিগ্র্যান্ট প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য পাখি প্রজাতিগুলি হল : শালিক, দোয়েল, বুলবুল, ফিঙে, পিউ কাঁহা বা পাপিয়া, পেঁচা, কোকিল, ছাতারে প্রভৃতি। 


সবুজে মোড়া, ইতিহাস সমৃদ্ধ গোপগড় ইকোপার্ক পিকনিক বা বনভোজন, প্রকৃতিকেন্দ্রিক বিনোদন, ট্রেকিং বা হাইকিংয়ের জন্য আদর্শ স্থান। গোপগড় ইকোপার্কের প্রধান দ্রষ্টব্যগুলি হল : (১) গোপগড় হেরিটেজ হাউস : গোপগড়ের প্রধান ঐতিহাসিক স্মারক গোপগড় হেরিটেজ হাউস। ছোটো লাল ইটের (প্রায় ১.৫-২ ইঞ্চি) তৈরি এই অট্টালিকা বর্তমানে জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এটি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়নি এখনও। এই অট্টালিকার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। গোপগড় ইকোপার্কের ফলকে এই অট্টালিকাকে লোকস্মৃতি মতে 'বিরাট রাজার স্মৃতি বিজড়িত স্থান' বর্ণনা করা হয়েছে৷ তবে, মেদিনীপুরের ইতিহাস গবেষক চিন্ময় দাশের মতে, ‘হেরিটেজ ভবন’-এর তকমা প্রাপ্ত লাল ইটের ভাঙাচোরা এই অট্টালিকা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। শোনা যায়, তেলিনিপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের কোনও এক জমিদার বাগানবাড়ি হিসেবে বাড়িটি বানিয়েছিলেন। (২) ওয়াচ টাওয়ার : গোপগড় ইকোপার্কের ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো এলাকার রোমাঞ্চকর দৃশ্যপট দেখা যায়। দেখা যায়, দূরে বয়ে চলা কংসাবতী নদী এবং রেলসেতু। (৩) ফুলের বাগান : শীতকালে রঙিন সমস্ত ফুলের সমাহার গোপগড় ইকোপার্কের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। ১০-১২ রকমের গোলাপ, ডেইজি, ল্যাভান্ডার, গাঁদা, সূর্যমুখী, লিলি, ডালিয়া ইত্যাদি ফুল এবং ফুলের বাগানে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির দল আপনাকে মুগ্ধ করবে৷ (৪) গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল স্টেশন : ব্রিটিশ যুগে প্রায় সমগ্র ভারত জুড়ে যে গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে (১৮০২-১৮৭১) করা হয়েছিল, তারই একটি স্টেশন গোপগড়ে রয়েছে। পিরামিড আকৃতির এই গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল স্টেশনে গোপগড়ের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা এবং উচ্চতার উল্লেখ রয়েছে। (৫) প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য : যেকোনো ইকোপার্কের মতো গোপগড়েও অন্যতম দ্রষ্টব্য প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। গোপগড় ইকোপার্কে প্রজাপতি ও পক্ষী বৈচিত্র্য দেখার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি সম্পর্কে যে কারও জ্ঞান ও উৎসাহ বাড়বে৷ এছাড়া জঙ্গলের বুক চিরে সরু পথ বেয়ে 'ট্রেইলিং'-ও বেশ আকর্ষণীয়। গোপগড় ইকোপার্কের অন্যান্য আকর্ষণগুলি হল : প্রজাপতি উদ্যান, অর্কিডেরিয়াম, রঙিন মাছের মৎস্যাধার, সেলফি জোন প্রভৃতি। 


শীতকালে বিশেষত বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষে গোপগড় ইকোপার্কে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। পর্যটকদের জন্য গোপগড় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (WBSFDA)-এর দুটি কটেজ (পথিক ও প্রিয়া) রয়েছে। গোপগড় ইকোপার্কে একটি সভাকক্ষ ও শিশু উদ্যান রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫:৩০ টা অবদি গোপগড় ইকোপার্ক খোলা থাকে। পার্কিং এরিয়া, ফুড কোর্ট (টিফিন স্টল), পিকনিক স্পট প্রভৃতির সুবিধা রয়েছে। ৬ বছরের উর্দ্ধে জনপ্রতি প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। এছাড়া পিকনিক, যানবাহন, ক্যামেরা ও শ্যুটিং ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত মূল্য লাগে। গোপগড় ইকোপার্ককে আরও আকর্ষণীয় করতে টয়ট্রেন, রোপওয়ে সহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিহাস, জনশ্রুতি আর প্রকৃতির মিশেলে গোপগড় ইকোপার্ক এক জনপ্রিয় 'শর্ট ট্যুর ডেস্টিনেশন'। দিনের শেষে, সন্ধ্যা নামার মুখে যখন পাখিরা নীড়ে ফেরে, তখন গোপগড়ের পুরোনো স্মৃতিগুলি জীবন্ত রূপ ধারণ করে এক অসামান্য নির্জনতায়।

***************************************

তথ্যসূত্রঃ- আনন্দবাজার পত্রিকা ; Wikipedia ; গোপগড় ইকো ট্যুরিজম পার্ক - আনন্দরূপ নায়েক (৩১ শে জুলাই, ২০২২), Midnapore.in ; বর্তমান পত্রিকা ; WBSFDA Ecotourism ; এই সময় ; West Bengal Heritage Commission, Government of West Bengal ; Official Website of Paschim Medinipur District, Government of West Bengal

Sunday 7 May 2023

আশ্চর্য সীমারেখা ওয়ালাস লাইন (wallace-line)

 ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একগুচ্ছ ছোটবড় দ্বীপের সমাহার মালয় দ্বীপপুঞ্জ। এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ইন্দোনেশিয়ার বালি ও লম্বকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে এক প্রাচীন অদৃশ্য সীমারেখা– ওয়ালাস লাইন (Wallace Line)। ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড রাসেল ওয়ালাসের নামে এর নামকরণ হয় ১৮৫৯ সালে।



ওয়ালাস লাইনের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য এর জীববৈচিত্র্য। এই অদৃশ্য লাইনের (The Invisible Barrier) পশ্চিমে ঘন জঙ্গলে দেখা যায় হাতি, বাঘ, গন্ডার প্রভৃতি। কিন্তু পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ পাল্টে যায় প্রাণীজগতের চরিত্র (2 Worlds Apart)। দেখা যায় কোয়ালা, কোমাডো ড্রাগন, হানিইটার ইত্যাদি প্রাণীর বাস। প্রকৃতির এই অদ্ভূত খেলার কারণেই ওই অদৃশ্য রেখাটিকে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন জৈবভৌগোলিক সীমানা (Biogeographic boundary) হিসেবে।



কীভাবে তৈরি হল জৈবভৌগোলিক সীমানার ধারণা? ইতিহাস বলছে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) তত্ত্বের সহ প্রবক্তা অ্যালফ্রেড ওয়ালাস আট দিনের মালয় সফরে এই এলাকায় বালি ও লম্বকের মধ্যে সামান্য ব্যবধানে দু-ধরনের জীববৈচিত্র্য দেখতে পান। তিনি এই গোটা সফরে বহু প্রজাতির প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেন।

ওয়ালাসের মৃত্যুর প্রায় দেড়শো বছরের বেশি সময় পরে ভূবিজ্ঞানীরা অনুমান করেন পৃথিবীর জন্মলগ্নে প্লেট টেকটনিক তত্ত্বের কারণেই এই দুটি এলাকায় এত সামান্য দূরত্বে জীববৈচিত্র্যের এত বিপুল পার্থক্য ঘটেছে। এই প্লেট টেকটনিক তত্ত্বের ভিত্তিতেই বিভিন্ন মহাদেশের জন্ম, পাহাড় পর্বত সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।



গবেষণা বলছে, প্লেট টেকটনিকের ফলে পৃথিবীতে সৃষ্ট সবচেয়ে জটিল অঞ্চলগুলির একটি হল মালয় দ্বীপপুঞ্জ । সেই কারণেই এই অঞ্চলে এমন অদ্ভূত জীববৈচিত্র্য। ১৯৮০-র দশকে বিজ্ঞানীদের বদ্ধমূল ধারণা হয় ওয়ালাস লাইনের উদ্ভব প্লেট টেকটনকেরই কারণে, জীবদ্দশায় যার সন্ধান দিতে পারেননি স্বয়ং ওয়ালাস। তবে ওয়ালাস লাইনের (Wallace Line) দুদিকের এলাকা সুদূর অতীতে একটাই অবিভক্ত অঞ্চল (landmass) ছিল সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন।


এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া – দুটি মহাদেশের বন্যপ্রাণী ওয়ালাস লাইনের যথাক্রমে পশ্চিম ও পূর্বদিকে দেখা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে জোরালো ও শক্তিশালী সমুদ্রস্রোতের ফলে বন্যপ্রাণীরা ওয়ালাস লাইন অতিক্রম করে পশ্চিম থেকে পূর্বে বা পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসা যাওয়া করতে পারে না।

ওয়ালাসের অদৃশ্য সীমারেখা (The Invisible Barrier) বাস্তব হতে পারে আবার কাল্পনিকও হতে পারে। কিন্তু আদিম পৃথিবীর নানা ভূতাত্ত্বিক ঘটনা কীভাবে আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে, কীভাবে জীববৈচিত্র্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি করে দেয়, ওয়ালাস লাইন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

 https://www.thewall.in


Friday 21 April 2023

২২ শে এপ্রিল, পৃথিবী দিবস (Earth Day)

 আর্থ ডে মানে বিশ্ব দিবস বা পৃথিবী দিবস। অর্থাৎ আমাদের মাতৃ গ্রহ পৃথিবীর জন্য একটি দিবস। বিশ্বব্যাপী কতো দিনই না আমরা উদযাপন করে আসছি বিশেষ বিশেষ দিনে আর আজকে কিনা এই বিশ্বেরই বিশ্ব দিবস! প্রতি বছর এপ্রিলের ২২ তারিখ বিশ্বের মোটামুটি সব দেশেই এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা হয় বিশ্বের ভালো কিছু করার লক্ষ্যে, উন্নয়নের লক্ষ্যে। প্রতিবছর এই দিনটি পরিবেশ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করা হয়। Earth Day Network সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বের ১৯৩ টিরও বেশি দেশে পৃথিবী দিবস বা ধরিত্রী দিবস পালিত হয়ে থাকে। ১৯৭০ সালের ২২ শে এপ্রিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম পৃথিবী দিবস পালিত হয়। এই এপ্রিলের ২২ তারিখ পৃথিবী বা ধরিত্রী দিবস হিসেবে পালিত হবে এই মতবাদের স্থাপক শ্রদ্ধেয় গেইলর্ড নেলসন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গেলর্ড নেলসন ২২ শে এপ্রিল ১৯৭০ পরিবেশ শিক্ষন কর্মসূচীর মাধ্যমে পৃথিবী দিবসের প্রতিষ্ঠা করেন। যিনি ১৯৭০ সালে প্রথম বাস্তুসংস্থান এবং দুনিয়ার জীবনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আনার কথা বলেন এবং তিনিই প্রথম মানুষকে মাটি, বাতাস ও জলের যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন সেই সম্পর্কে ভাবতে, সচেতন হতে সচেষ্ট করেন। সমগ্র আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই উদযাপন কর্মসূচীর জাতীয় সংগঠক ছিলেন ড্যানিস হায়েস। ১৯৯০ সালে পৃথিবী দিবস আন্তর্জাতিক রূপ পায় এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। 



এই দিনটির প্রতীক হিসেবে মানুষ বিভিন্ন প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহার করে থাকে যেমনঃ ইমেজ বা ড্রইং যা পৃথিবীকে বোঝায়, এছাড়াও গাছ, ফুল বা পাতা যা পরিবেশের পরিচিতি বহন করে। এই দিনের বিশেষ রং হলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক রং যেমন- নীল, সবুজ বা ধূসর রং।

কি করে মানুষ এই দিনে

সাধারণত ২২শে এপ্রিল আর্থ ডে উপলক্ষে মানুষ নানারকম উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড করে থাকে। এই ধরনের কাজ কেউ কেউ একা করে , কেউবা আবার সম্মিলিতভাবে করে থাকে। সাধারণ কিছু কাজকর্মের মধ্যে গাছ লাগানো, রাস্তার ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে আসা, কখনো কখনো রাস্তা পরিষ্কার করা, অব্যবহৃত জিনিস থেকে পুনরায় ব্যবহারের জন্য জিনিস বানানো ইত্যাদি কাজ করে থাকে। কেউ কেউ আবার জনসাধারণের সাক্ষর একত্র করে পিটিশন বানিয়ে সরকারকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলে। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় নানারকম কর্মসূচির আয়োজন করে।

এই দিনটিতে শিশুকিশোর, বৃদ্ধ-বণিতা সবার একটাই শপথ এই বিশ্বকে কিছু দেয়া। এর উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। অনেকেই এই দিনে সভা-সেমিনার করে, র্যা লি বের করে, মার্চ করে, বিশ্বের পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে। কেউ রোড শো করে যা রাস্তা নাটক হিসেবে পরিচিত, কেউ বা ডকুমেন্টারি বানায় সাধারণ মানুষদের সঠিক জিনিসটি বোঝানোর জন্য এবং উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

এটি কোন ছুটির দিন নয়। এই বিশ্ব দিবসটা কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কোন ছুটির দিন বরাদ্দ করে না, না এটা কোন আনন্দ-উপভোগ করে কাটাবার সময়। এই দিনটি আসে এটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য যে আমরা নানাভাবে এই পৃথিবীর কাছে ঋণী এবং এই ঋণ শোধের জন্য আমাদেরও পৃথিবীর কাছে দায় রয়েছে।

এই একটা দিনে পৃথিবীর কোনায় কোনায় বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন গোত্রের, বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোক এক লক্ষ্যে একই কাজ করে, একই শপথ নেয় যে- এই পৃথিবীটা আমাদের, একে বাঁচিয়েও রাখতে হবে আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং বাঁচাতে হবে আমাদেরই হাত থেকে। অন্তত এই একটা দিন আমরা নিজেদের এই পৃথিবীটার জন্য কিছু করি... পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগাই, রিসাইক্লিং করি, গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের হাত থেকে মুক্ত করি বিশ্বকে। নিজেকে ঋণমুক্ত করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি-ই বা হতে পারে!

পৃথিবী দিবস!

প্রতিদিন একজন মানুষ ৩২৯৭ টাকার অক্সিজেন ব্যবহার করেন। বছরে তার পরিমান দাঁড়ায় ১২ লক্ষ ৩ হাজার ৪শ ৫ টাকা। যদি ৬৫ বছর বাঁচি তাহলে অক্সিজেন বাবদ আমাদের খরচ দাঁড়ায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। এত টাকার অক্সিজেনের সবটুকুই বিনামূল্যে পাচ্ছি আমাদের চারপাশের গাছ পালা থেকে। আমাদের অনেকেই জীবনের সাথে গাছের ভূমিকাকে বেমালুম ভুলে যান এবং গাছ কেটে পৃথিবীকে ধ্বাংসের মুখে ফেলে দিচ্ছেন।

আসুন গাছ লাগাই পৃথিবী বাঁচাই।

Wednesday 1 March 2023

মঙ্গলদীপ ইকো ট্যুরিজম পার্ক

 নদীয়া জেলার রানাঘাট-১ ব্লকের পায়রাডাঙ্গা শিবপুরে ভাগীরথী এবং চূর্ণীর সঙ্গমস্থলে উদ্ভূত চর যা মঙ্গলদ্বীপ নামে পরিচিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত একটি স্থান । অঞ্চলটির ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক 23°7'39" উত্তর, 88°29'57" পূর্ব। এটি ভাগীরথী নদী ক্রুজ বরাবর একটি ট্যুরিস্ট ট্রানজিট পয়েন্ট-কাম-রিসর্ট হিসাবে গড়ে উঠেছে। 


 চলে আসুন কলকাতার এক্কেবারে কাছেই মঙ্গল দ্বীপে। হুগলি নদীর উপরে তৈরি হয়েছে এই মঙ্গলদ্বীপ। মাঠ-ফাগুনের দুপুরে জমিয়ে চড়ুইভাতি করে নেওয়া যেতে পারে। আবার নিছক বেড়াতেও বেশ মন্দ লাগবে না। নদীর মাঝে বিশাল এই দ্বীপ এখন পর্যটকদের নতুন ডেস্টিনেশন বললে ভুল হবে না। সেখানে তৈরি করা হয়েছে একটা পার্কের মত।

পায়রাডাঙ্গা রেল স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পায়রাডাঙ্গা শিবপুরঘাট থেকে নৌকায় ভাগীরথী পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টুরিস্ট স্পট মঙ্গল দ্বীপের সুন্দর মনোরম পরিবেশে পৌঁছে যেতে পারেন। চারিদিকে  নদী বেষ্টিত এই দ্বীপ। জনবসতী নেই এই নদীর চড়ায় কেবল গাছ গাছালি রয়েেছ। বড় বড় বৃক্ষেরও দেখা মিলবে এখানে। আপনি যদি নদীর মাঝখানে একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট খুঁজছেন তবে হ্যাঁ এই জায়গাটি আপনার পূর্বের পছন্দ হওয়া উচিত। সুন্দর এই দ্বীপে গড়ে উঠেছে একটি ইকো ট্যুরিজম পার্ক। বিস্ময়কর ল্যান্ডস্কেপ, মনোরম আবহাওয়া, মৃদুমন্দ বাতাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই জায়গাটিকে একটি নিখুঁত পর্যটক ও পিকনিক স্পট বানিয়েছে। 


নদীর তীরে অবস্থিত, এটি একটি পার্ক, বাগান এবং দুটি কটেজ নিয়ে গঠিত একটি পিকনিক স্পট। এইরকম পরিবেশে শীতের মরসুমে বনভোজন অর্থাৎ চড়ুইভাতির আমেজটাই আলাদা। সন্ধ্যায় হুগলি বরাবর একটি বোটিং ভ্রমণ অবশ্যই স্মরণীয় হবে এবং আপনাকে সেই জায়গায় ফিরিয়ে আনবে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য এখানে নেই। এখানে পিকনিক করতে হলে নিজেদের খাবার নিয়ে যেতে হবে অথবা রান্নার সব সরঞ্জাম নিয়ে যেতে হবে। তবে জলের পর্যাপ্ত সুবিধা রয়েছে। পার্কের মধ্যেই পরিশ্রুত পানীয় জলের বন্দোবস্ত রয়েছে। আপনি স্থানীয় ক্যাটারিংয়ের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন বা সেখানে খাবার নিজেরাই রান্না করতে পারেন। এখানে রান্না ও পরিবেশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। পার্কিং সুবিধা রয়েছে।  

মঙ্গলদ্বীপের কাছেই রয়েছে গোয়াইয়ের চড়। গঙ্গা আর চূর্ণি নদীর সঙ্গমস্থলে তৈরি হয়েছে এই গোসাইয়ের চর। সেখানে আবার নোকার হাল বেয়ে চলে না। এপার ওপারে দড়ি টাঙানো রয়েছে। সেই দড়িই বেয়েই যায় নৌকা। হাল টানতে হয় না মাঝিকে। গোসাইয়ের চরে মূলচ চাষবাস হয়ে থাকে । প্রচুর কলা গাছের বাগান রয়েছে। রয়েছে বড় আম বাগান। মঙ্গলদ্বীপে ঘুরতে এসে অনেকেই চলে আসেন এই গোসাইয়ের চর দেখতে। 

কিভাবে পৌঁছবেন? শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে আপনাকে পেয়ারাডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনে আসতে হবে। শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, গেদে গামী যেকোনো লোকাল  ট্রেনে আসতে পারেন। তারপর, টোটো  বা অটোতে শিবপুরঘাট এখনথেকে নৌকায় ভাগীরথী পার হয়ে পৌঁছে যান মঙ্গলদীপ ইকো ট্যুরিজম পার্কে। 




দক্ষিণের ডুয়ার্স ঝালুয়ারবেড় (Jhaluarber)

 ডুয়ার্স! তাও আবার দক্ষিণে।! হ্যাঁ দক্ষিণে। দক্ষিণের ডুয়ার্স ‘ঝালুয়ারবেড়’। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার ডোমজুর মহকুমায় অবস্থিত মকরদহ-২ (Makardah- ii) গ্রাম পঞ্চায়েত একটি গ্রাম হল ঝালুয়ারবেড় (Jhaluarber)। অঞ্চল টির ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক হল: ২২°৩৭′৪০″ উত্তর, ৮৮°১৫′১০″ পূর্ব। একটা সময় গোটা এলাকাটাই জঙ্গলে ঘেরা ছিল। বর্তমানে বেশ কিছু জায়গা বসবাসের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই ঝালুয়ারবেড়ের মানুষ দিনযাপন করেন এখানে।

 দক্ষিণের ডুয়ার্স নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে একপ্রকার স্বর্গ বলা যেতে পারে। ঝালুয়ারবেড়ও ডুয়ার্সের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে চমকে দিতে প্রকৃতিকে ঢেলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে অকৃত্রিমভাবে। সেখানে একটিই মাত্র রেললাইন। তার পাশে পটে আঁকা একটি প্ল্যাটফর্ম। তার পাশ ঘেঁষে ঘন জঙ্গল। সেখানে এক শীতদুপুরে...শর্ট টাইম আউটিং’ (স্বল্প সময় ভ্রমণ) বেড়িয়েই পডুন  ঝালুয়ারবেড় দক্ষিণের ডুয়ার্সের উদ্দেশ্যে। 

 জনমানবহীন এই নিরিবিলি জায়গাটিতে ঘোর দুপুরেও শোনা যায় ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক। স্টেশনে দাঁড়িয়েই মনে হবে কোনো গহীন জঙ্গলে বোধহয় দাড়িয়ে আছেন। সুন্দর এই স্টেশনের মোহ কাটিয়ে কিছুটা এগোলেই দেখবেন একটা কালী মন্দির। এই মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটির দুপাশ জুড়ে ঘন বাঁশ বন। শুধু তাই নয়, বাঁশ গাছগুলো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাস্তাটিকে ঢেকে রেখেছে। মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হবে যেন আস্ত এক বাঁশ গাছের গুহা। দুপুরে সূর্যের আলোটুকুও ভালো ভাবে মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। আবার শীতের দিনে কুয়াশা ঘেরা এই রাস্তাটি অপরূপ এক মায়াবি দৃশ্যের সৃষ্টি করে। জীর্ণ সেতুর গায়ে গা এলিয়ে দিয়েছে তার হলুদ শরীর, রোদ পোয়াচ্ছে বুড়ো গো সাপ। সেতু এখানে নির্জন। অচেনা পায়ের আওয়াজ পেয়ে চকিতে খালের জলে গিয়ে নামে সাপ। হয়ত মন খারাপ হয় বকটার, নুইয়ে পড়া গাছের ডাল থেকে নিমেষে উড়ে পালায় চোখের আড়ালে। এই জঙ্গলের পাহারাদার বুনো কুকুর আর বুনো বেড়াল। দাঁত বের করে ফ্যাঁসস করে আপনার পায়ের আওয়াজকে  আমন্ত্রণ জানাবে। ফ্যাঁসসটা হয়ত চলে যাওয়ার আদেশ। দুর থেকে সামান্য বিরতি দিয়ে তক্ষক ডেকে উঠছে। ঘোর দুপুরেও কানে তালা ধরায় ঝিঁঝিঁ। এখানে দিগন্তে তারা দেখা যায় সন্ধ্যার আগে আগেই। ঝালুয়ারবেড়কে বাস্তবিকই গরীবের ডুয়ার্স হয়ে মনের শান্তি হতে পারে।  

অন্য দিকে জঙ্গল যেখানে কম সেখানে উপভোগ করার মত রয়েছে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি। খেত জুড়ে বিভিন্ন ফসলের চাষ এবং খেতের মাঝখান দিয়ে রয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। জংলি গাছে ফুটে থাকা সাদা-হলুদ ফুল আর রঙিন প্রজাপতি পলকে মন আচ্ছন্ন করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। রাস্তার ধারের খালটা পুরো সবুজ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কচুরিপানায় ঢাকা। সেই খালের শেষ দেখা যায় না। দু’পাশের গাছপালার ডাল খালের জলের উত্তাপ মেপে নিতেই যেন ঝুঁকে থাকে। শীতের সূর্য আর কুয়াশা বিকেলের সময়টা সেখানে লুকোচুরি খেলে। সন্ধ্যে নামলে অনেক সময় শিয়াল ও অন্যান্য বন্য জন্তুও বেরোয়। তাই সেসময় রাস্তাটি বেশ বিপজ্জনকও বটে। রাত গাঢ় হওয়ার আগেই এখানে শোনা যায় পেঁচার ডাক। এখানে মুহূর্তে যযেন মনটা কেমন হয়ে ওঠে। 

হাওড়া থেকে আমতাগামী ট্রেনে মাত্র ৪০ মিনিটের রাস্তা।হাওড়া থেকে জঙ্গলে যাওয়ার ট্রেনের টিকিটের দাম ১০ টাকা। সন্ধ্যার পর সেটি বলার জন্য কাউকেই আর পাবেন না। শীতের রাত গড়ানোর আগেই জঙ্গলে ঘেরা স্টেশনে দাঁড়ালে গা ছমছম করে। রাত গাঢ় হওয়ার আগে পেঁচা ডাকে। তার ডাকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভেসে আসে লাস্ট ট্রেনের ভোঁ। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত কৃত্রিমভাবে ডুয়ার্সের স্বাদ পেতে এই শীতেই না হয় একবার ঘুরে আসুন দক্ষিণের ডুয়ার্সে। বিশাল এই কংক্রিটের শহরে এক টুকরো বন্যপ্রকৃতি আপনার মনের প্রশান্তি জোগাবেই!


প্রাচ্যের প্যারিস পুদুচেরি

 


ভারতের সাতটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম পুদুচেরি। ২০০৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর নতুন নামকরণ হয়েছিল 'পুদুচেরি'। প্রায় ৭১১,৯৩৪ জনসংখ্যা সহ এই ৪৯২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার পুদুচেরি ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি আধুনিক শহর। শহরটি 'পন্ডি' (Pondi) নামেও পরিচিত। এ যেন ভারতে বিদ্যমান ফ্রান্সের একটি অংশ। আর এই শহরকেই বলা হয় প্রাচ্যের প্যারিস।


'পুদুচেরি' শব্দের তামিল অনুবাদের অর্থ 'নিউ টাউন' বা নতুন নগর। এই নাম রেখেছিলেন ফরাসি তামিলিয়ানরা।অতীতে ফরাসিদের উপনিবেশ থাকায় পুদুচেরিতে তার রেশ আজও রয়ে গেছে। 


ফ্রান্সের প্যারিস ভ্রমণের স্বপ্ন সবার মনেই থাকে। বেশিরভাগ মানুষ ছুটেন সেখানে প্যারিসের বিভিন্ন স্থাপনা এমনকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মুগ্ধ করে সবাইকে।  তবে প্যারিস ভ্রমণ তো আর মুখের কথা নয়। আপনি যদি প্যারিস ভ্রমণের স্বপ্ন দেখেন তাহলে ঘুরে আসতেই পারেন ভারতের ‘প্রাচ্যের প্যারিস থেকে’। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হই চই করতে যেমন ভালো লাগে, তেমনই তাঁদের সঙ্গে নিরিবিলিতে সময় কাটাতেও ভালো লাগে। আর তার জন্য আদর্শ জায়গা পুদুচেরি। শীতকালে এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম থাকে। পুদুচেরিতে ফরাসি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপস্থিত অত্যন্ত প্রকট। পুদুচেরি যেন ফ্রান্সের একটি অংশ। এখানকার ফ্রেঞ্চ কলোনিগুলিতে গেলে মনে হবে যেন প্যারিসের অলিগলিতে ঘুরছেন। সেই কারণেই পুদুচেরিকে বলা হয় 'প্রাচ্যের প্যারিস'।


পুদুচেরি ভ্রমণে যা যা দেখবেন


সমুদ্র সৈকত

পুদুচেরির সমুদ্র সৈকত দারুণ সুন্দর। সেখানকার সরকারি ভবনগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রের ধারে অবস্থিত। সৈকতসংলগ্ন রাস্তাগুলোও অত্যন্ত পরিষ্কার। চাইলে আপনি খালি পায়েও হাঁটতে পারবেন। এই অঞ্চলের চারপাশে ১০টিরও বেশি সৈকত আছে। তবে সার্ফিংয়ের জন্য অরোভিল বিচ জনপ্রিয়। ব্যাক ওয়াটার বোটিং উপভোগ করারও দারুণ জায়গা প্যারাডাইস বিচ।যোগাসনের জন্য শান্তিপূর্ণ জায়গা পেতে চাইলে যেতে পারেন প্রমেনেড বিচে। সান বাথ ও মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত মাহে বিচ। ক্যানোয়িংয়ের জন্য আদর্শ কারাইকাল সমুদ্র সৈকত।


ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার

ইন্দো-ফরাসি নিদর্শনের সেরা উদাহরণ হলো ফ্রেঞ্চ কলোনির ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার্স ও সেখানকার রাস্তাগুলো। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারগুলো হোয়াইট টাউন নামে পরিচিত।ক্যাথেড্রালের ঐতিহ্য ও স্থাপত্য অনুসারে ফ্রেঞ্চ ভিলাগুলো ধূসর, সাদা, পিচ ও হলুদ রঙে রাঙা। সেখানকার ভারতি পার্ক, অরবিন্দ আশ্রম, লা মেসন রোজ, কিউরিও সেন্টার ও নটরডেম অ্যাঞ্জেস ঘুরে দেখতে দারুণ লাগে।


অরোভিল কমিউন

পুদুচেরি ভ্রমণে যাবেন অথচ অরোভিলে যাবেন না, তা কি হয়! সেখানকার উন্নতমানের অ্যাসেনশিয়াল অয়েল, ধূপকাঠি ও সূক্ষ্ম হস্তশিল্প বিখ্যাত। এছাড়া লাল বালির পাথরের অ্যাম্ফিথিয়েটারের নাম মাতৃমন্দির, বুটিক ডি অরোভিল, মন্ত্র পটারি, লা ফার্ম চিজ ও অরোভিল বেকারির সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারবেন।


তামিল কোয়ার্টার ব্ল্যাকটাউন

ফরাসিদের জন্য যেমন হোয়াইট টাউন, তেমনই তামিল ব্রাহ্মণ ও বণিকদের জন্য আছে ব্ল্যাকটাউন। সেখানকার ঘরবাড়ি ইমারতগুলোতে তামিল সংস্কৃতি স্পষ্ট। সেখানে আরও আছে মইসন তামোলে ও মেসন পেরুমলের মতো জনপ্রিয় তামিল ভবন। এটি তার অ্যাকুয়ারেলাস গ্যালারিতে আছে অমূল্য সব শিল্প সম্পদ।





গোলাপী শহব় জয়পুর (Pink City Jaypur)

 

জয়পুর ভারতের রাজস্থান রাজ্যের সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী। এর ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক: ২৬.৯২৬০° উত্তর ৭৫.৮২৩৫° পূর্ব। জয়পুর গোলাপী শহব় নামে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্ণে গোলাপী এবং স্পন্দনে গোলাপী, জয়পুর শহরটি ভারতের অন্যতম সুন্দর এবং আকৰ্ষণীয় শহর। জয়পুরের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ঐতিহ্য, শিল্প, গহনা এবং টেক্সটাইল সবসময়ই ভ্রমণকারীদের কাছে মনোরম করে তুলেছে । এটি এমন একটি শহর যা আধুনিকীকরণের পরেও এখনও এর মূল এবং মূল্যবোধকে ধারণ করে চলেছে আজও।

১৭২৭ সালে আমের রাজ দ্বিতীয় জয় সিং-এর-এর আমলে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। জয়পুর যে একটি সুপরিকল্পিত শহর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। এছাড়া সওয়াই জয় সিংকে শহরের স্থাপত্য নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন বাংলার একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। বর্ধিত জনগোষ্ঠী ও পানীয় জলের সহজলভ্যতার সুবিধার্থে রাজার নির্দেশে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য শহরের স্থাপত্যনকশা করেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, শহরের প্রধান স্থানগুলি-রাস্তা, চত্বর, প্রাসাদ এবং সীমানাগুলির দুর্গ গঠনের জন্য সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা কৌশল তৈরি হতে ৪ বছর সময় লেগেছিল। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বাস্তুশাস্ত্রের কৌশলগুলিকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল এই সুন্দর সাজানো শহর। ১৭২৭ সালের ১৮ই নভেম্বর জয় সিং নিজেই শহরটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

জয়পুর গোলাপী শহব় নামে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে কাব়ণ প্ৰায় সবগুলো কাঠামো নির্মাণের জন্য একচেটিয়াভাবে ব্যবহৃত কব়া হয়েছে গোলাপী ব়ঙেব় পাঁথব়। যে এই শহরটি প্রত্যক্ষ করেছেন, তিনি জয়পুরের সমস্ত ভবন গোলাপী তাব় প্রমাণ পাবেন। এই গোলাপী রঙের শহব়টিব় রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। যেহেতু গোলাপী ব়ঙ আতিথেয়তার রঙ বোঝায়, তাই জয়পুরের মহারাজা রাম সিংহ অতিথিদের স্বাগত জানাতে পুরো শহরটিকে গোলাপী রঙে এঁকেছিলেন। এই ঐতিহ্যটি এখনও সেখানকাব় বাসিন্দারা আন্তরিকভাবে অনুসরণ করে এবং এখন আইন অনুসারে গোলাপী রঙ বজায় রাখতে বাধ্য।

১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং রানি ভিক্টোরিয়া ভারত সফরে আসার কথা ছিল। তাঁদেরকে স্বাগত জানাতে ‘পাধারো মাহেরে দেশ’–এর সারমর্ম জীবন্ত করে তুলতে মহারাজা গোটা শহরকে টেরাকোটা গোলাপী রঙে সাজিয়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন সময়ে গোলাপী রঙ  বা Pink ছিল আত্মীয়তার প্রতীক। সেখান থেকেই জয়পুর “Pink City”নামে পরিচিতি লাভ করে। লর্ড অ্যালবার্ট  ‘Pink City’ নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। আজ পর্যন্ত জয়পুরের সেই ঐতিহ্যকে বজায় রাখা হয়েছে। আজও জয়পুরের ঐতিহাসিক গেট ও স্কোয়ারগুলিতে আতিথেয়তার রঙ হিসেবে গোলাপী রঙ ধারণ করে রয়েছে। জয়পুরের ইতিহাসে নিজেকে বুনতে পারদর্শী এই গোলাপি শহর। পুরানো ঐতিহ্যকে বজায় রাখাতে শহরের সমস্ত বাড়ি-ঘর যেন গোলাপী রঙের হয় তার জন্য আইন পাশ করা হয়। তাই জয়পুরের কোন বাড়িঘর গোলাপি ছাড়া অন্য কোন রঙ দিয়ে পেইন্ট করা দেখতে পাওয়া যায় না।
১৯২২ সালে দ্বিতীয় মান সিং সিংহাসন দখল করলে তিনি শহরে স্কুল, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর যোধপুর, জয়সালমীর এবং বিকানেরের সঙ্গে এক হয়ে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য জয়পুর ও রাজস্থানের রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর ‘পিঙ্ক সিটি’ তথা ‘গোলাপী শহর’ হিসাবে খ্যাত এবং খুবই জনপ্রিয় গন্তব্য। যার টানে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক  ছুটে আসেন বছরভর। এখানকার বিশেষ দর্শনীয় স্থানগুলি হল : যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, হাওয়া মহল, বিড়লা মন্দির এবং বেশ কয়েকটি প্রাচীন কেল্লা। প্রাচীন জয়পুরের প্রধান কেল্লাগুলো শহরের উত্তর-পূর্বে আরাবল্লী পর্বতচূড়ায় অবস্থিত। আমের কেল্লা (১৫৯২), সবচেয়ে প্রাচীন কেল্লা ও উত্তরভাগে অবস্থিত। জয়গড় কেল্লা (১৭২৬), আমের কেল্লার পাশেই অবস্থিত, মূলত এটি প্রতিরক্ষামূলক কেল্লা। নাহারগড় কেল্লা (১৭৩৪), দক্ষিণভাগে অবস্থিত, বর্তমান শহরের সুউচ্চ দর্শন পেতে আদর্শস্থান।

বাহাদুরপুর বনাঞ্চল(শান্তিপুর) (Bahadurpur Forest Santipur)

 

নদিয়া (Nadia) জেলার শান্তিপুর (Shantipur) ব্লকের বাবলা পঞ্চায়েতের অধীন বাহাদুরপুর গ্রামে (Bahadurpur Village) বাহাদুরপুর বনাঞ্চল অবস্থিত। অঞ্চলটির GPS স্থানাঙ্ক 23.25, 88.4667 । এটি বন দফতর (West Bengal Forest Department) এর অধীনে নদীয়া-মুর্শিদাবাদ ফরেস্ট ডিভিশনের (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) অন্তর্গত একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় পর্ণমোচী অরন্য। অবসর যাপনে সরাসরি প্রকৃতির স্পর্শ অনুভব করার জন্য  ভাল জায়গা। ছোট কিন্তু বেশ ও শান্তিপূর্ণ বন।
বাহাদুরপুর বনে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখা যায়। এটি এই এলাকার মানুষ এবং অনেক প্রাণীর জন্য  সহায়ক। এটি আংশিক পর্ণমোচী ও আংশিক চিরহরিৎ শ্রেণীর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এখানে আপনি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ দেখতে পারেন। জঙ্গলটি বেশ ঘন। এখানে বট, অশ্বথ, সেগুন,শিশু, বাবলা, নিম, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, অর্জুন এছাড়াও অনেক মূল্যবান গাছ আর হরেক প্রজাতির গুল্ম মিলে সবুজ করে দেবে আপনার অবসরযাপন। ভিতরে পশুপাখি বলতে তেমন কিছুই নেই।তবে কিছু হনুমান ও সাপ দেখা যায়। বন্যপ্রাণী বলতে বেজী, খরগোশ, হনুমান দেখা যায়। সরীসৃপদের ভেতরে দেখা যায় গোখরা, দাঁড়াস গুই সাপ প্রভৃতি। এখানে আপনি বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় পাখি দেখতে পারেন, যেমন- দোয়েল, ফিঙে, ডাহুক, শালিক, বাদুড়, বাজ, বক, মাছরাঙা, পানকৌড়ি ও নাম না জানা হরেক প্রজাতির পাখি। প্রকৃতির সরাসরি স্পর্শ অনুভব করার জন্য প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য ভাল জায়গা।

শান্তিপুর স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায় এখানে আসতে হলে স্টেশন থেকেই টোটো বুক করতে হবে। অথবা আপনি গাড়ি নিয়ে আসতে পারেন তবে হ্যাঁ জঙ্গলের একেবারে ভিতরে কোন গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। পুরোটা পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করতে পারেন। চারপাশে সবুজ গাছপালা, এই সবুজ পাতা এবং মুক্ত বাতাস ও অক্সিজেন আপনাকে সতেজ করে তুলবে। অবসর কাটানোর জন্য দারুণ জায়গা। আর খুব ভালো পিকনিক স্পট।
জঙ্গলটির ভিতরে বছরে একবার একটা মেলা বসে মাত্র একদিনের জন্য। শুধুমাত্র দোলের দিন এই মেলাটি বসে। বন্ধুরা মিলে একবার ঘুরে আসতে পারেন। সুন্দর শান্ত ছিমছাম পরিবেশ ঘিরে রেখেছে বনটিকে। স্বর্গের মত সুন্দর জায়গা। আপনি যদি প্রকৃতিকে অনুভব করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই এই জায়গায় আসতে হবে। ছোট অ্যাডভেঞ্চারের জন্য দুর্দান্ত জায়গা। ফটোগ্রাফারদের জন্য স্বর্গরাজ্য।  কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে চারিদিকে রাসেল ভাইপার এ ভর্তি। আর এখানে এলে অবশ্যই মশার সাথে যুদ্ধ করার সাহস নিয়ে আসবেন। এই জায়গাটিতে খুব বেশি পর্যটকদের সমাগম ঘটে দেখা যায় না। সুতরাং, কেউ যদি নিঃসঙ্গ জায়গাগুলি দেখতে পছন্দ করেন তবে এই জায়গাটি তার। তবে সন্ধ্যার পর সেখানে থাকবেন না। এটি রাতে নিরাপদ নয়।

লেখক:-
অয়ন বিশ্বাস
ঘোড়ালিয়া, শান্তিপুর, নদীয়া।

শান্তিপুর রাষ্ট্রীয় উদ্যান

 


নদীয়া জেলার শান্তিপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে শান্তিপুর কলেজের ঠিক পাশে শান্তিপুর রাষ্ট্রীয় উদ্যানের অবস্থিত। এই রাষ্ট্রীয় উদ্যান বন অধিদপ্তর, আরবান রিক্রিয়েশন ফরেস্ট্রি ডিভিশন, কল্যাণী রেঞ্জের অধীনে। এটি অনেক শোভাময় গাছপালা এবং গাছ দিয়ে সজ্জিত। এখানে একটি সুন্দর পুকুর আছে এবং এখানে বোটিং এর ব্যবস্থাও আছে। অনেক মূল্যবান ও পুরাতন গাছ আছে।

প্রায় পাঁচ দশক আগে তৈরি হয় এই উদ্যানটি ৷ বনদপ্তরের উদ্যোগে  ফুল ও বাহারি পাতার গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে ৷ উদ্যানের ভিতরের একটি পুকুর রয়েছে ৷ পুকুরটি  চারপাশ বাঁধানো, পুকুরের পাশে বসার ব্যবস্থা ৷ ভিতরে রয়েছে একটি নতুন শিশু উদ্যান ৷ সেখানে আছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইডের ব্যবস্থাও । 

আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারেন সুন্দর নিরিবিলি মনোরম পরিবেশে। এখানে যে কোন উপলক্ষ উদযাপন করতে পারেন, পিকনিক স্পটের ও ব্যবস্থা আছে। পর্যটকদের টানতে তৈরি করা হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়া। উদ্যানটি নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলার জন্য উদ্যানের ভেতর একটি ট্রেন ও একটি পাখিরালয় তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। আশা সৌন্দার্যায়ন বৃদ্ধির ফলে পর্যটকদের উৎসাহ বাড়বে, মানুষ ভিড় জমাবে শান্তিপুর রাষ্ট্রীয় উদ্যানে। 

এই জায়গাটি সাধারণত বাগানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত কিন্তু বসন্ত ঋতুতে এটি নদীয়া জেলার সবচেয়ে বড় বসন্ত উৎসবের জন্য শান্তিপুরের মানুষের কাছে প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ ও  তরুণ প্রজন্ম অংশ নেয় পবিত্র বা দোল উৎসবের পাশাপাশি বসন্ত উৎসব উদযাপন করতে।

ফুল ও বাহারি পাতার গাছ দিয়ে সাজানো, সুন্দর বাঁধানো পুকুর,মূল্যবান ও পুরাতন শোভাময় গাছপালা দিয়ে সজ্জিত স্থানটি আপনি ফটোগ্রাফি ও শুটিং এর জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তবে শুটিং এর জন্য অনুমতি প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় উদ্যানে প্রবেশ টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ২০/- টাকা।

 সহজ সড়ক ও রেল যোগাযোগ এর মাধ্যমে আপনি চলে আসুন শান্তিপুর। শান্তিপুর স্টেশন থেকে টোটোতে পৌঁছাতে পারেন শান্তিপুর রাষ্ট্রীয় উদ্যানে। 

 

ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। কারণ ভারত বহুভাষাভাষীর দেশ। সংবিধানে সমস্ত ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাতিকে সমান অধিকার এবং সম্মান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই শুধু একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সকল ভারতবাসীর ভাষা বলে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সকল ভারতবাসী একি ভাষার মানুষ নন। আর একজনের ভাষাকে আর একজনের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা সংবিধান পরিপন্থী। কাজেই ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই। এ প্রসঙ্গে বলি, অনেকেই হয়তো জানেন না যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই।

কিন্তু একটা দেশ চালাতে হলে তো একটা ভাষা দরকার। স্বাধীনতার সময় গান্ধিজীর কথায় শেষ কথা ছিল, তিনি হিন্দি ভাষাকে সবার উপর চাপানোর পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু সবাই মিলে এটাই ঠিক হয়েছিল যে একটা দেশীয় ভাষাকে কেন্দ্র সরকারের ভাষা বলে গ্রহণ করা হবে এবং যতদিন না সমস্ত ভারতবাসী হিন্দি ভাষাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করছে, ততদিন ইংরেজি ভাষা অহিন্দি ভাষীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হবে। যে কারণে সরকার টিভি রেডিও এবং সিনেমার মাধ্যমে হিন্দি ভাষার প্রচার এবং প্রসারের চেষ্টা করে এসেছে। বর্তামানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দি ভাষীরা অহিন্দি ভাষীদের তুলনায় নিজেদের বেশি কিছু ভাবতে শুরু করে এবং অজ্ঞতা বা অহঙ্কারের কারণে সবার উপর হিন্দি চাপানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু মানুষ শিক্ষিত হয়েছে। ফলে এখন আর কোনো অহিন্দি ভাষীরা নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বিশর্জন দিয়ে হিন্দি ভাষা গ্রহণ করতে রাজী নয়। হিন্দি ভাষীদের ঔদ্ধত্যের কারণে এখন আর কেও হিন্দিকে সমস্ত ভারতবাসীর ভাষা বলে মানতে চায় না। আর মানুষ স্বেচ্ছায় না করলে সরকার জোর জোর করে চাপাতে পারবে না। তাহলে সেটা শুধু সংবিধান লঙ্ঘন হবে তাই না, দেশটাও ভেঙ্গে যাবে। তাছাড়া বর্তমানে প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে এবং ইংরেজি ভাষা বিশ্বভাষায় পরিণত হওয়ায় হিন্দির প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে। সমস্ত ভাষারই উন্নতি হয়েছে।

ফলে ভারতে কেন্দ্র সরকার হিন্দি এবং ইংরেজি দুটো ভাষাতেই কাজ চালায়। অর্থাৎ হিন্দি এবং ইংরেজি হল ভারতের কেন্দ্র সরকারের ভাষা। সমস্ত রাজ্য সরকারের ভাষা নয়। আর সংসদে কোনো সাংসদ ওই ২২টা ভাষার যে কোনো একটা ভাষায় বক্তব্য রাখতে পারেন। সাংসদদের হিন্দি বা ইংরেজিতেই বক্তব্য রাখতে হবে এমন নয়। তবে দুটি ভিন্ন ভাষার মানুষ যেভাবে উভয়েই জানে এমন একটা ভাষা ব্যবহার করে কথা বলে, সেরকমি ভারতীয়রা ভিন্নভাষী কারো সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে।

মনে রাখা দরকার ভারতের সংবিধানে ২২ টা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভারতবাসীরা নিজেদের এলাকার যে সরকারি ভাষা সেটা শেখে, আর ইংরেজি শেখে নিজ রাজ্যের বাইরে বা দেশের বাইরের মানুৃষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। ভারত এটা বিশাল বড় দেশ। ৮০% মানুষ জীবনে কোনোদিন নিজের রাজ্যের বাইরো বেরোয় না। ফলে ২২টা'র মধ্যে যেকোনো একটা সরকারি ভাষা জানলেই সাধারন মানুষের জীবন কেটে যাবে।

যারা কেন্দ্র সরকারের চাকরি করে তারা ইংরেজি জানলেই হবে। যদি হিন্দি ভাষী এলাকায় বাস করতে চান বা সে এলাকায় চাকরি করতে চান তাহলে সেখানকার স্থানীয় ভাষা তো শিখতেই হবে।

ভারতের “আই এ এস” এবং “আই পি এস” অফিসাররা কেন্দ্র সরকারের কর্মচারী হলেও তাদের যে রাজ্যে পাঠানো হয় সে রাজ্যের ভাষা শেখানো হয়। কারণ তাদের সাধারন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে উত্তর প্রদেশের একজন হিন্দিভাষী ব্যক্তি মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক হয়ে এলেন, তাহলে তাকে বাংলা শেখানো হবে।


ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারত সরকারের দাপ্তরিক ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দি এবং ইংরেজি। সংবিধানে কোনো জাতীয় ভাষা নেই। হিন্দি এবং ইংরাজি বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা হয়; যেমন, সংসদের কাজে, আইন ও বিচার বিষয়ক কাজে, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের মধ্যে বার্তা প্রেরণে ইত্যাদিতে। রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা আছে তাদের নিজেস্ব সরকারি ভাষা ঠিক করার। মূলত ১৪.৫-২৪.৫% মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন, তবে মোটামুটি ৪৫% ভারতীয় হিন্দিভাষী অথবা এর কাছাকাছি ভাষায়। এই ৪৫% জনগণ হিন্দি ভাষা ভাষী রাজ্যে বসবাস করেন। বাকি ভারতীয় ভাষাগুলিতে কমবেশি ১০% করে জনগণ কথা বলেন।

রাজ্যগুলি আইন মোতাবেক তাদের সরকারি ভাষা ঠিক করতে পারে। সংবিধানের এই ধারায় রাজ্যগুলি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারবে তাই নয়, রাজ্যের নিজেস্ব বিভিন্ন সরকারি কাজেও তারা সেই ভাষা গুলি ব্যবহার করতে পারবে এবং এই ভাষাগুলোর মাধ্যমে রাজ্য দেশের সাথেও সংযোগ স্থাপন করে।

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ইংরাজি তাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় স্তরে ব্যবহার হত। ১৯৫০ সালে সংবিধান গ্রহণের সময় পরিকল্পনা নেওয়া হয় ১৫ বছরের মধ্যে ধিরে ধিরে ইংরাজির বদলে হিন্দিকে বসানো হবে, কিন্তু পরবর্তীকালে আইন প্রনয়ন করে ইংরাজির ব্যবহার বহাল রাখা হয়। পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী হিন্দিকে একক ভাবে সরকারি ভাষা করতে গেলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাধা আসতে থাকে। অন্যান্য রাজ্যের সরকারি ভাষাকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দি আজও সরকারি ভাষা হিসাবে চলে আসছে। কিন্তু সংবিধানে কোনো রাষ্ট্র ভাষা নেই।


 ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন কাল থেকে বিবিধ ভাষা প্রচলিত রয়েছে। আসুন একনজরে দেখা যাক -- ভারতের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী সম্পর্কে-

★ ভারতের প্রধান ভাষাগোষ্ঠী হল মূল ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের শাখাগোষ্ঠী ইন্দো-আর্য। ভারতের ৭৮.০৫% মানুষ ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।

★ ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশের দেশীয় ভাষাগোষ্ঠী হল -- দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠী। ভারতের ১৯.৬৪% মানুষ দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।

★ ইন্দো-আর্য এবং দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠী ছাড়াও ভারতে আরও কয়েকটি ভাষাগোষ্ঠী রয়েছে। যেমন -- অস্ট্রো-এশিয়াটিক, সিনো-তিব্বতীয়, তাই-কদাই প্রভৃতি। ভারতের ২.৩১% মানুষ এইসব ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।

★ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সরকারি ভাষা বৈচিত্র্য সমীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৮৯৮-১৯২৮ সালে, স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসনের নেতৃত্বে।

★ ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতের বৃহত্তম (ভাষার জনসংখ্যা অনুসারে) ভাষা হল -- হিন্দি। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫৭.১০% হিন্দি ভাষা ব্যবহার করেন। 

★ ভারতে প্রচলিত ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান ভাষাগুলি হল -- হিন্দি, বাংলা, কোঙ্কনি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, কাশ্মীরি, রাজস্থানি, সিন্ধি, অসমীয়া, মৈথিলি, ওড়িয়া। ভারতে প্রচলিত দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান ভাষাগুলি হল -- তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালাম। 

★ ভারতের কোনো সরকারি ভাষা নেই। সংবিধানের অষ্টম তপশীলে ২২ টি ভাষাকে সরকারি রূপে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল -- অসমীয়া, বাংলা, বোড়ো, ডোগরি, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, কোঙ্কনি, মৈথিলি, মালয়ালাম, মেইতেই, মারাঠি, নেপালি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, সাঁওতালি, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু, ও উর্দু।

★ ২০০৪ সালে ভারত সরকার 'Classical Language' মর্যাদা চালু করে। এই তালিকায় বর্তমানে রয়েছে -- তামিল (২০০৪), সংস্কৃত (২০০৫), কন্নড় (২০০৮), তেলেগু (২০০৮), মালয়ালাম (২০১৩), ওড়িয়া (২০১৪)।

★ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন (০১/০৭/২০১৮) অনুসারে, ২০১১ জনগণনাতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ভারতে ১৯,৫৬৯ টি বাচিক ভাষা / উপভাষা (Dialect) রয়েছে। ভারতে ১০ হাজার বেশি লোক ব্যবহার করেন, এরূপ ১২১ টি ভাষা রয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৯৬.৭১% মানুষ সংবিধানের অষ্টম তপশীলে স্বীকৃত ২২ টি ভাষার অন্তর্গত।

******************************************

তথ্যসূত্রঃ- 

1. Wikipedia 

2. The Indian Express

3. Census of India 2011

4. Quora media

Friday 10 February 2023

‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’

       ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ছিলেন মেধাবী মেহেদী হাসান খান। কিন্তু শিক্ষকরা বলেছিলেন, - মেডিকেল  কলেজ ছেড়ে দেওয়া উচিত মেহেদীর। কারণ, ডাক্তারির পড়াশুনা বাদ দিয়ে, দিন-রাত এক করে, খাওয়া-ঘুম ভুলে হোস্টেলের ঘরেই একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে মেহেদী তখন লড়ছিলেন অন্য লড়াই। বাংলা ভাষার জন্য লড়াই।


মেহদী হাসান খান একজন বাংলাদেশী  চিকিৎসক  ও  প্রোগ্রামার। তিনি ২০০৩ সালে ইউনিকোড ও এএনএসআই  সমর্থিত বাংলা লেখার বিনামূল্যের ও মুক্ত সফটওয়্যার অভ্র কী-বোর্ড তৈরি করেন। ১৯৮৬ সালের ২৩ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০১ সালে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৩ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন।

১৮ বছর বয়সের যুবক স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলা ভাষাকে সারা পৃথিবীর কাছে খুব সহজে পৌঁছে দেওয়ার। কম্পিউটারে বাংলা লিখতে তাঁর খুব অসুবিধা হয়, এবং সেই পদ্ধতি মেহেদীর পছন্দ নয়। তাই তিনি চান এমন একটা সফটওয়্যার, যার সাহায্যে ইংরেজি অক্ষরে টাইপ করেই বাংলা লেখা সম্ভব।

বন্ধুরা মেহেদীকে বলে পাগল, ডাক্তারি পড়তে এসে কেউ সময় নষ্ট করে! তাও আবার নাকি বাংলা লেখার সুবিধার্থে! কিন্তু মেহেদী মেহেদীই। বাংলা ভাষার জন্য তাঁর দেশের মানুষ প্রাণ দিতে পারেন, আর সেই বাংলাকে লেখার দিক থেকে সহজ করতে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে পারবেন না! হাল ছাড়েননি মেহেদী।



২৬ মার্চ,২০০৩ সাল, মেহেদীর জীবনে শুধু নয়, লক্ষ লক্ষ বাঙালির জীবনের একটি বিশেষ দিন। সেই দিন মেহেদী বিশ্বের সামনে আনলেন ‘অভ্র’ সফটওয়ার। যা আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের সব চেয়ে পছন্দের বাংলা রাইটিং সফটওয়ার। আজ বাঙালির কম্পিউটার, ল্যাপটপ খুললেই স্ক্রিনে একটি স্লোগান ভেসে ওঠে ,,, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’। এটিই ডাক্তার মেহেদী হাসান খানের তৈরি করা স্লোগান। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ভাষাকে উন্মুক্ত করতে হবে সবার জন্য, বেঁধে রাখা যাবে না জটিলতার নাগপাশে।

মেহদী তার প্রথম বাংলা ফন্ট ইউনিবিজয় ডট নেট ফ্রেমওয়ার্ক ও ভিজ্যুয়াল বেসিক উপর লেখেন। পরে তিনি অভ্র কী-বোর্ড ব্যবহারকারীদের সুবিধার্তে ডট নেট ফ্রেমওয়ার্ক ছাড়াই লেখেন। অভ্র সম্পূর্ণভাবে ইউনিকোড উপযোগী, যা ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম দ্বারা ২০০৩ সালের ১৪ জুন স্বীকৃত হয়। তিনি তার সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওমিক্রনল্যাব প্রতিষ্ঠা করেন। অভ্র কী-বোর্ড প্রথম উন্মুক্ত করা হয় ২০০৩ সালে ২৬ মার্চ। ওমিক্রনল্যাব থেকে অভ্র উন্মুক্ত করা হয় ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে অভ্র ব্যবহার করে।

আজ কিন্তু তিনি ডাঃ মেহেদী হাসান খান। হাজার তাচ্ছিল্য সত্ত্বেও তিনি ‘অভ্র’ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেছেন ডাক্তারিও। 

২০১১ সালে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে বেসিস পুরস্কার দেওয়া হয়।

আজ ভারত ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘অভ্র কিপ্যাড’। বিদেশীরাও আজ তাদের ভাষাতেই লিখতে পারছে আমাদের বাংলা ভাষা।  লেখতে পারছে লেখা হচ্ছে সরকারি ফাইল থেকে পরিচয়পত্র। মেহেদীর এই আবিষ্কার বাঁচিয়ে দিয়েছে দুই দেশের কোটি-কোটি টাকা। যার জন্য এত কিছু, সেই মানুষটাকে আমরা চিনিই না। চিরকাল প্রচারবিমুখ, ৩৪ বছরের এই বিনয়ী তরুণ বাংলা ভাষার জন্য এত বড় অবদান রেখে গেলেও, রয়ে গেলেন প্রচারের আলোর বাইরেই। তোমায় শতকোটি সালাম হে বীর!


তথ্যসূত্র:

1.Wikipedia

2. Social media





Thursday 26 January 2023

সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ মাছ পুজো করা হয় কেন?

 

ভোজনপ্রিয় বাঙালিদের বারো মাসে তের পার্বণ। যে কোনও উৎসব, আনন্দ-উদযাপনের একটা 'কমন ফ্যাক্টর' হল খাওয়া - দাওয়া। সেরকমই প্রতিটা পুজো -পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হরেক রকম পদ। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বসন্ত পঞ্চমী (Vasant Panchami) বা সরস্বতী পুজো (Saraswati Puja) হয়। এদিন বহু বাঙালি বাড়িতে নিয়ম আছে জোড়া ইলিস বরণ (Jora Ilish Boron)। অনেকেই সারা বছর মুখিয়ে থাকেন সরস্বতী পুজোর দিন ইলিশ মাছ ( Hilsa Fish) খাওয়ার জন্য। হিন্দু ধর্মে, জোড়া ইলিশ কেনা খুব শুভ বলে মনে করা হয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রীতি। তবে এই রীতি, পশ্চিমবাংলার আদি বাসিন্দারা অর্থাৎ এদেশীয়রা পালন করেন না। এটি পূর্ববঙ্গীয়দের রীতি। শোনা যায়, জোড়া ইলিশ মাছ বরণ পূর্ববঙ্গের দক্ষিণের জেলাগুলিতেই বেশি প্রচলিত ছিল। তার মধ্যে বিক্রমপুর অঞ্চলেই এই প্রথার উদ্ভব বলে মনে করা হয়।
এটি মূলত পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি সরস্বতী পুজোর কোনও সম্পর্ক নেই। এই পদটি মূলত শ্রীপঞ্চমীর দিনে খাওয়ার রেওয়াজ। ওই একই দিনে সরস্বতী পুজো হয় বলে একই দিনে দু’টি পালিত হয়।

সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ মাছ বরণ পূর্ববঙ্গীয়দের এক অন্যতম লোকাচার। কিছু বাড়িতে আবার এদিন, ইলিশ মাছের বিয়ে দেওয়ার রীতি আছে। যদিও মনে করা হয়, সরস্বতী পুজোর সঙ্গে এই রীতির সরাসরি কোনও যোগ নেই। তবে একই চান্দ্র তিথিতে হয়, দুই অনুষ্ঠান। বসন্ত পঞ্চমীর দিন সকালে কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা ইলিশ কিনতে যেতেন। এরপর ধান, দূর্বা, তেল, সিঁদুর ও কাঁচা হলুদ সহযোগে মাছটি উলু ও শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে, কুলোর উপর সাজিয়ে রাখা হয়।


 
 কিছু পরিবারে, জোড়া ইলিশ মাছ বরণের সময়, দুটি গোটা বেগুন ও লাউ ডগাও রাখা হয়। অনেক পরিবারের নিয়ম, দুটির জায়গায় একটি ইলিশ মাছা বরণ করা। সেখানে ইলিশের সঙ্গে নোড়া রাখা হয়, যাকে নোড়া দিয়ে জোড়া বা ইলশার বিয়ে বলে। নোড়াটি পুরুষ এবং মাছটিকে নারীর রূপে ধরা হয় এবং উলু- শঙ্খ ধ্বনি, ধান- দূর্বা, তেল, সিঁদুর, কাঁচা হলুদ দেওয়া হয় তখন।  
বহু পরিবারে জোড়া ইলিশ বরণের সময় মুখে টাকা গুঁজে দেওয়া হয়। যিনি মাছ কাটবেন, সাধারণত এই টাকাটি তার প্রাপ্য। তবে মাছা কাটার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ নিয়ম। আঁশ এদিক ওদিক যাতে ছড়িয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কলাপাতার উপর রেখে অনেকে আঁশ ছাড়ান। পরে সেটি মুড়ে যে কোনও পরিষ্কার স্থানে তা পুঁতে দিতে হয়। 



কেন সরস্বতী পুজোয় এই নিয়ম? (Saraswati Puja Rituals) 

এই নিয়ে নানা মতভেদ আছে। তবে মনে করা হয়, পূর্ববঙ্গের মৎসজীবি সম্প্রদায়রা এক সময়, বিজয়া দশমীর পর আর ইলিশ মাছ ধরতেন না। বসন্ত পঞ্চমীর সময় থেকে আবার মাছ ধরতেন তারা। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ সময় থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কালে অপরিণত ইলিশ ধরা পড়ে। আসলে এটাই শিশু ইলিশদের সমুদ্রে ফেরার সময়। শোনা যায়, বহু যুগ আগে পূর্ব বাংলার মৎসজীবিরা এদিন বিশেষ মঙ্গলাচরণের মধ্যে দিয়ে ইলিশ ধরার সূচনা করতেন। 


আবার লোক মুখে শোনা যায়, ব্রাক্ষণরা আগে কট্টর নিরামিষাশী থাকার ফলে মাছ খেতেন না। এরপর ধীরে ধীরে প্রচলন হল শাস্ত্রে বলা আছে যে, মাছেরা আসলে সমুদ্রের ফল বা জল তরু তাই অনায়াসে মাছকে শাক সব্জির মধ্যে ফেলা যায়।

এই ইলিশ রান্নার বিশেষ পদ্ধতিও আছে। কীভাবে রান্না হয় সরস্বতী পুজোর ইলিশ? জোড়া ইলিশ বরণ করার পর এই মাছ রান্নার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ রীতি। এক ফোড়ন দিয়ে এই রান্না হয়। অর্থাত্‍ ফোঁড়ন এবং সমস্ত তরকারি একসঙ্গেই দিতে হয় কড়াইতে। তার পরে জল দিতে হয়। হলুদ বাটার ঝোল ফুটে উঠলে মাছগুলি কাঁচা অবস্থায়ই ঝোলে দিতে হয়।এই রান্নায় কোনও গুঁড়ো মশলা যেমন গুঁড়ো হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, ইত্যাদি ব্যবহার করার নিয়ম নেই। কাঁচা হলুদ এবং কাঁচা লঙ্কা ব্যবহার করে এই পদ রান্না করা হয়। 

বর্তমানে উৎসবের এই মেজাজ ও রীতিনীতি অনেকটা শিথিল হয়েছে কর্ম ব্যস্ততার জন্য। তবে শহরে কম হলেও, গ্রামাঞ্চল বা শহরতলিতে এখনও এই পার্বণ ব্যাপকভাবে উদযাপিত হয়। সরস্বতী পুজোয় অনেকেই বাড়িতেই জোড়া ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে এখনও।

Wednesday 25 January 2023

সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই কেন?

 

ছোটবেলা থেকেই আমরা সকলেই শুনে আসছি সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই। বাড়ির বড়রা, ছোটদের বলেন পুজোর আগে কুল খেলে দেবী সরস্বতী খুব রেগে যান। তবে এর কারণ অনেকেরই অজানা।
মূলত মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যা বসন্ত পঞ্চমী নামে পরিচিত। সারা বছর ধরে সকলেই বিশেষ করে কচি কাঁচা ও শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করে থাকেন এই বিশেষ দিনটির জন্য। সরস্বতী পুজোর সঙ্গে যে নামটা খুবই পরিচিত তা হল কুল (Jujube Fruit)। ছোট্ট এই ফল এই পুজোয় বিশেষভাবে দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। টক- মিষ্টি স্বাদের ছোট্ট ফল- কুল প্রায় সকলেরই খুব প্রিয়। কুলের সঙ্গে সরস্বতী পুজোর একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা সকলেরই জানা। শুধু ঘরে ঘরে নয় স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিষ্ঠা করে হয় বাগদেবীর আরাধনা। দেবীর সামনে দোয়াতের উপরও একটি নারকেল কুল রাখার নিয়ম রয়েছে। সকাল থেকে উপোস করে অঞ্জলী দিয়ে তার পরেই প্রসাদে কুল খাওয়ার রীতি বহুদিন ধরে। 



পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে মূলত বাজারে কুল পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে আসছি সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই। বাড়ির বড়রা, ছোটদের বলেন পুজোর আগে কুল খেলে দেবী সরস্বতী খুব রেগে যান। পরীক্ষায় পাশ করা কিংবা ভাল নম্বর পাওয়া নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। তবে এর কারণ অনেকেরই অজানা। সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়র পিছনে রয়েছে বহুপ্রচলিত  লোকাচার, শাস্ত্রীয় ও স্বাস্থ্যগত কারণ। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই কারণ গুলি সম্পর্কে।



শাস্ত্র মতে দেবী সরস্বতীকে তুষ্টক রার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছিলেন। শোনা যায়, সে তপস্যার আগে দেবী সরস্বতী তাঁর তপস্যাস্থলের পাশেই একটি কুল বীজ রেখে একটি শর্ত দিয়েছিলেন। সেই শর্তানুযায়ী বলা ছিল, যতদিন না কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বড় গাছ হবে এবং সেই গাছের ফল পেকে ব্যাসদেবের মাথার উপর পড়বে। ততদিন অবধি দেবীর তপস্যা করতে হবে। তারপরেই দেবী, তাঁর তপস্যায় তুষ্ঠ হবেন। সেই শর্তানুযায়ী, ব্যাসদেব তপস্যা শুরু করেন এবং যেদিন গাছের নতুন ফল তাঁর মাথায় পড়ে, তিনি বুঝতে পারেন দেবী তাঁর তপস্যায় তুষ্ঠ হয়েছেন। বিশেষ দিনটি ছিল পঞ্চমী। সেই দিন দেবীকে বদ্রী/কুল নিবেদন করে ব্যাসদেব ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেছিলেন। সেইজন্যই শ্রীপঞ্চমীর দিনই সরস্বতী দেবীকে নিবেদন করার পর কুল খাওয়া হয়। তবে শাস্ত্রে সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া নিষিদ্ধ, এ রকম কোনও কথা নেই।


সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়ার পিছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রচলিত রীতি। তার মধ্যে কৃষি প্রধান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। হিন্দু ধর্মে কোনও মরসুমের প্রথম ফলই দেবতাদের উৎসর্গ করে খাওয়ার রীতি রয়েছে। পৌষ-মাঘ এই সময়টাতে বাজারে খুব সহজে এবং ভাল বিভিন্ন রকমের কুল মেলে। আর সেই সময়ই পঞ্চমী তিথিতে হয় সরস্বতী পুজো। তাই বসন্ত পঞ্চমীতেই উৎসর্গ করে তা প্রসাদ হিসেবে খাওয়ার রীতি। 
প্রচলিত এই লোকাচারের পিছনে আরও একটি কারণ রয়েছে। বসন্তকালে বিভিন্ন রকমের রোগ দেখা দেয় চারিদিকে। সর্দি-কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা এই সময়ে ঘরে ঘরে লেগে থাকে। আধ পাকা বা কাঁচা কুল বসন্তকালে খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও এই ফল মারাত্মক টক হয় যা দাঁতের জন্যে ক্ষতিকারক। তাই এটি খাওয়ার নিয়ম নেই সেই সময়ে।

স্বাস্থ্যগত কারণেও সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া ঠিক নয়। কারণ মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগে কুল কাঁচা বা কশযুক্ত থাকে। কাঁচা বা কশযুক্ত কুল থেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।



তথ্যসূত্র: 

১) আনন্দবাজার পত্রিকা

২) নিউজ 18 বাংলা

৩) আজতক বাংলা।

Monday 2 January 2023

২১ জুন, উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে বড় দিন উত্তরায়ণ (Summer Solstice)




 ২১ জুন, উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে বড় দিন। ভূগোলের পরিভাষায় একে বলা হয় Summer Solstice বা উত্তরায়ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিরক্ষরেখার উত্তর অংশে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে এখন গ্রীষ্মকাল বা সামার সিজন। আর ২১ জুন এই সামার সিজনের সবচেয়ে বড় দিন। এই নির্দিষ্ট দিনে সূর্যরশ্মি সরাসরি ট্রপিক অফ ক্যানসার বা ক্রান্তীয় কর্কটরেখার উপর পড়ে। আরও ভাল ভাবে বললে বলা যায়, উত্তর অক্ষাংশের উপর ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে এসে সূর্যরশ্মি পড়ে।


Summer Solstice বা উত্তরায়ণ কীভাবে হয়?

মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে দেশগুলিতে বেশি পরিমাণ সূর্যালোক পৌঁছয়। এর ফলে এই সময়কালে এখানে সামার সিজন বা গ্রীষ্মকাল থাকে। একেই বলে Summer Solstice। এই Solstice- এর সময়কালে পৃথিবী যখন তার অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করে, তখন উত্তর গোলার্ধে অংশ সূর্যের দিকে বেশি হেলে থাকে। আর দক্ষিণ গোলার্ধ থাকে কিছুটা দূরে। এই পরিস্থিতিতে ২১ জুন তারিখে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সূর্যালোক এসে পৌঁছয় উত্তর গোলার্ধে। কারণ এইদিনই অক্ষের উপর প্রদক্ষিণ করার সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে সবচেয়ে বেশি হেলে থাকে।

Summer Solstice- এর সময় পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর প্রদক্ষিণকালে সূর্যের দিকে যে হেলে থাকে, এই কৌণিক পরিমাণ ২৩.৫ ডিগ্রি। নাসার মতে, এই বিশেষ দিন অর্থাৎ ২১ জুন যে পরিমাণ সূর্যালোক নিরক্ষরেখায় পৌঁছয়, তার থেকে ৩০ শতাংশ বেশি এনার্জি বা সূর্যালোক উত্তর গোলার্ধে পৌঁছয়। তার ফলেই এই নির্দিষ্ট দিনে উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে বড় দিন দেখা যায়। মূলত ২০, ২১ এবং ২২ জুন— এই তিনদিনই বেশি সূর্যালোক পৌঁছয় উত্তর গোলার্ধে। তার মধ্যে ২১ জুন সবচেয়ে বেশি সূর্যরশ্মি পৌঁছয় উত্তর গোলার্ধে।

তবে Summer Solstice বা উত্তরায়ণ অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে বড় দিন মানে কিন্তু তাড়াতাড়ি সূর্যোদয় আর দেরি করে সূর্যস্ত— এই ঘটনা বোঝায় না। এমনকি উত্তর গোলার্ধের সর্বত্রই কিন্তু এই অধিক পরিমাণ সূর্যরশ্মি পৌঁছয় না। সবটাই নির্ভর করে অক্ষাংশগত অবস্থানের উপর।

২৫শে ডিসেম্বর সত্যি কি বড় দিন?

 


আমার সকলেই জানি ২৫শে ডিসেম্বর বড় দিন। এই পবিত্র দিনে যিশু খ্রিস্টের জন্ম দিন পালন করা হয়। ২৫শে ডিসেম্বর সত্যি কি বড় দিন? না আদতে তা নয়।আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে দীর্ঘতম দিন এবং দীর্ঘতম রাতের কথা কমবেশি সবাই পড়েছি। দিনের দৈর্ঘ্যের বিচারে ২১শে জুন, বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন। আর ২৫শে ডিসেম্বর বড়দিন বা ক্রিসমাস একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব।

২৫শে ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিন বা ক্রিসমাস উৎসব পালিত হয়। এই পবিত্র দিনে যিশু খ্রিস্টের জন্ম দিন পালন করা হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু। প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হলেও অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে বড়দিন উত্‍সব পালন করে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্‍সবের আয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভাবনার সমাবেশও দেখা যায়। উপহার প্রদান, সংগীত, বড়দিনের কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং বড়দিনের বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উত্‍সব উদযাপনের অঙ্গ।

২১শে জুন, হল বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম দিন। সৌরজগতের নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার সময় একদিকে একটু হেলে থাকে। ফলে কখনো উত্তর গোলার্ধ সূর্যের কাছে আসে, কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ।

[এখানে জেনে রাখা দরকার উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধ বলতে কোন অঞ্চলকে বোঝায়। উত্তর গোলার্ধ হল- সমগ্র উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান (বিদেশী শাসিত অঞ্চলগুলো ব্যতীত)। পূর্ব তিমুর এবং ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ গোলার্ধের অংশ ব্যতীত এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ। আফ্রিকা মহাদেশের দুইতৃতীয়াংশ। দক্ষিণ আমেরিকার এক-দশমাংশ।
এবং এন্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার নয়-দশমাংশ, আফ্রিকার দক্ষিণভাগের একাংশ, এবং এশিয়ার কিছু দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ, চারটি মহাসাগর (ভারত, দক্ষিণ আটলান্টিক, দক্ষিণ মহাসাগর, এবং দক্ষিণ প্রশান্ত) এবং ওশেনিয়ার অধিকাংশ। এশিয়া মহাদেশের কিছু মহাদেশীয় দ্বীপও দক্ষিণ গোলার্ধের অন্তর্ভুক্ত।]
মূলত ঋতু পরিবর্তনের পাশাপাশি দিন ও রাতের সময়কালও বদলে যায়। বছরের ৩৬৫ দিন কখনো সমান থাকে না। কখনো দিন ছোট হয় এবং রাত বড় হয়, আবার কখনো দিন বড় হয় এবং রাত ছোট হয়। ঠিক এমনভাবেই, বছরে এমন একটি দিন আসে, যাকে সবচেয়ে বড় দিন এবং রাত সবচেয়ে ছোট হিসেবে ধরা হয়। ২১শে জুন, উত্তর গোলার্ধে বছরের সবচেয়ে বড় দিন। ভূগোলের পরিভাষায় একে বলা হয় Summer Solstice বা উত্তরায়ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিরক্ষরেখার উত্তর অংশে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে এখন গ্রীষ্মকাল বা সামার সিজন। আর ২১ জুন এই সামার সিজনের সবচেয়ে বড় দিন। এই নির্দিষ্ট দিনে সূর্যরশ্মি সরাসরি ট্রপিক অফ ক্যানসার বা ক্রান্তীয় কর্কটরেখার উপর পড়ে। আরও ভাল ভাবে বললে বলা যায়, উত্তর অক্ষাংশের উপর ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে এসে সূর্যরশ্মি পড়ে।

Summer Solstice- এর সময় পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর প্রদক্ষিণকালে সূর্যের দিকে যে হেলে থাকে, এই কৌণিক পরিমাণ ২৩.৫ ডিগ্রি। নাসার মতে, এই বিশেষ দিন অর্থাৎ ২১ জুন যে পরিমাণ সূর্যালোক নিরক্ষরেখায় পৌঁছয়, তার থেকে ৩০ শতাংশ বেশি এনার্জি বা সূর্যালোক উত্তর গোলার্ধে পৌঁছয়। তার ফলেই এই নির্দিষ্ট দিনে উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে বড় দিন দেখা যায়। 

Sunday 1 January 2023

কর্কটক্রান্তি রেখা স্থান পরিবর্তন




পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সাড়ে তেইশ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পূর্ণবৃত্ত কাল্পনিক রেখাটি হলো কর্কটক্রান্তি রেখা। কিন্তু জানেন কি এই কর্কটক্রান্তি রেখাটি প্রতি বছর সরে যাচ্ছে। আমরা জানি যে, কর্কটক্রান্তি রেখা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার উপর দিয়ে গিয়েছে। আমরা কৃষ্ণনগরের কাছে বাহাদুরপুর গেলে দেখতে পাব যে, এক জায়গায় খুঁটিতে লেখা আছে – “YOU ARE NOW CROSSING TROPIC OF CANCER”।

আপনারা কি জানেন, সেই কর্কটক্রান্তি রেখার সূচক খুঁটির অবস্থান প্রতিবছর পরিবর্তন ঘটছে।
আমরা যদি আজ সেই খুঁটি দেখে আসি তাহলে আমরা যে স্থানে দেখব, পরের বছর দেখব সেই স্থানে আর নেই, একটু সরে গেছে। অনেক সময় ভূগোলের ছাত্রছাত্রী সেখানে গিয়ে GPS গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ মেপে আবার সঠিক জায়গায় খুঁটিটি পুঁতে দিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল – কেন খুঁটিটির অবস্থান পরিবর্তন ঘটছে ?
আসলে প্রতিবছর কর্কটক্রান্তি রেখা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। পৃথিবী তার উল্লম্বরেখা অর্থাৎ অক্ষের সাথে সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণে অবস্থান করে। আসলে এটি গড় অবস্থান। একচল্লিশ হাজার বছর অন্তর এটি ২২.১-২৪.৫ ডিগ্রি ব্যবধানে থাকে।
পৃথিবীর উল্লম্বরেখার পরিবর্তন হয় বলেই কর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তি, সুমেরুবৃত্ত ও কুমেরুবৃত্ত রেখা একটু একটু করে সরে যায়।
২৩ ডিগ্রী ২৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড অক্ষাংশ রেখাটিকে কর্কটক্রান্তি রেখা বলা হলেও লম্ব আলোকপাতে আসল অবস্থান নির্ভর করে পৃথিবীর হেলে থাকার কৌণিক পরিমাণের উপর। আর সেই কোণটি প্রতি ৪১,০০০ বছরের একটি চক্রাকার পর্যায়ক্রমে ২১.৫ থেকে ২৪.৫ ডিগ্রীর মধ্যে বদলাতে থাকে। সেই হিসাবে বর্তমান পর্যায়ে কর্কটক্রান্তি রেখার অবস্থান প্রতি বছর আধ সেকেন্ড করে কমে আসছে। এছাড়া ধীর পরিবর্তন ছাড়াও আহ্নিক অক্ষটি ঘুর্ণনরত লাট্টুর মতই স্থায়ী না থেকে প্রিসেশন নামে একটি বলয়াকার গতি এবং ন্যুটেশন নামে একটি দোদুল্যমান গতি পরিদর্শন করে। ন্যুটেশনের পর্যায়কাল পৃথিবীর ক্ষেত্রে ১৮.৬ বছর এবং কৌণিক পরিমাণ প্রায় সাড়ে নয় সেকেন্ড। রেখাটি নির্দিষ্ট নয় এবং এটি প্রত্যেক বছর ১৫ মিটার(০.৪৮৬″) করে দক্ষিণদিকে সরে যাচ্ছে। রেখাটি ১৯১৭ সালে ছিল ২৩°২৭′ এবং ২০৪৫ সালে ২৩°২৬'অক্ষাংশে পৌঁছাবে।