ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দামানেই প্রথমবার ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। সাল ১৯৪২ দেশে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। অক্ষশক্তির জাপানি সেনা পোর্ট ব্লেয়ার আক্রমণ করে এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে৷ সে সময় পুরো আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশদের একমাত্র ঘাঁটি ছিল পোর্ট ব্লেয়ার। এদিকে, ১৯৪৩ সালের ২১ শে অক্টোবর সিঙ্গাপুরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সরকার (Provisional Government of Free India) গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়। ১৯৪৩ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর জাপান আজাদ হিন্দ সরকারকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ হস্তান্তর করে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জই হল ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভকারী প্রথম ভারতীয় অঞ্চল। ২৯-৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৪৩ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সফরে আসেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে। ১৯৪৩ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের মাটিতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ারেই (আন্দামান ক্লাবের সামনে জিমখানা মাঠে, যা বর্তমানে নেতাজী স্টেডিয়াম নামে পরিচিত) প্রথমবার জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন। এই সফরকালে রস দ্বীপে অবস্থিত প্রাক্তন ব্রিটিশ মুখ্য কমিশনারের বাসভবনে অবস্থান করেছিলেন। এই সফরকালেই নেতাজী আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নতুন নামকরণ করেন, যথাক্রমে 'শহীদ' ও 'স্বরাজ'। ১৯৪৫ সালের আগস্টে ব্রিটিশরা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পুনর্দখল করে এবং আজাদ হিন্দ সরকারের পতন ঘটে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নেতাজীর অন্তর্ধান ঘটে এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর এক বিরাট শূন্যতা...
অবশেষে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর, ২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সফরে এসে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র বসু এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনটি দ্বীপের নতুন নামকরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রস দ্বীপ (Ross Island)-এর নামকরণ করেন ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপ’ (Netaji Subhas Chandra Bose Dweep) ; নীল দ্বীপ (Neil Island)-এর নামকরণ করেন ‘শহীদ দ্বীপ’ (Shaheed Dweep) এবং হ্যাভলক দ্বীপ (Havelock Island)-এর নামকরণ করেন ‘স্বরাজ দ্বীপ’ (Swaraj Dweep)।
প্রধানমন্ত্রী নেতাজীর নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট এবং ৭৫ টাকার একটি বিশেষ মুদ্রাও প্রকাশ করেন৷ পাশাপাশি নেতাজীর নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাসও করেন মোদী৷
এরপর এই দিনটা সারা দেশ পরাক্রম দিবস হিসাবে উদযাপন করে।
নেতাজির ১২৬ তম জন্মদিবস উপলক্ষে আন্দামানে একটি স্মৃতিস্তম্ভেরও উদ্বোধন করেন মোদি।
এবার একনজরে দেখা যাক এই তিনটি দ্বীপগুলি সম্পর্কে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপ (Netaji Subhas Chandra Bose Dweep) : নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ হল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপের পূর্বনাম ছিল রস দ্বীপ। তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামুদ্রিক সমীক্ষক ড্যানিয়েল রসের নামে নামকরন করা হয়েছিল রস দ্বীপ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বীপের নতুন নামকরণের আগে পর্যন্ত কার্যকরী ছিল। দ্বীপটি কেন্দ্রীয় পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৩ কিমি (২ মাইল) পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই দ্বীপটি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ার দ্বীপপুঞ্জ উপবিভাগের অন্তর্গত এবং প্রশাসনিক ভাবে দক্ষিণ আন্দামান জেলার অন্তর্গত। অরণ্য অধ্যুষিত এই দ্বীপটি ১.২৫ কিমি লম্বা, ০.৫২ কিমি চওড়া এবং এই দ্বীপটির আয়তন ০.৩১২ বর্গকিমি। ১৯৭৯ সালে এই দ্বীপে কেন্দ্র তৈরি করে ভারতীয় নৌসেনা। এই দ্বীপের উত্তর প্রান্তে একটি লাইট হাউস রয়েছে। সমগ্র আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এই দ্বীপেই ব্রিটিশরা প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল। এই দ্বীপে তাল ও নারিকেল গাছ এবং ময়ূর ও চিতল হরিণ রয়েছে। বিশ শতকের গোড়ায় হরিণদের সেখানে রাখা হয়েছিল ব্রিটিশদের শিকার শিকার খেলার জন্য। এখন এই দ্বীপে হরিণরা মুক্ত বিচরণ করে। এই দ্বীপ জুড়ে পড়ে রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের কঙ্কাল। বুনোলতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় কমিশনারের অতীত বাংলো, গির্জা, বেকারি এবং পরিচয়হীন অজস্র দেওয়াল। দ্বীপের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ একটি পর্যটক আকর্ষণ। সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় "নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বীপ"।
শহীদ দ্বীপ (Shaheed Dweep): শহীদ দ্বীপের পূর্বনাম ছিল নীল দ্বীপ, যা ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জন নীলের নামে নামকরণ করা হয়েছিল৷ এই দ্বীপটি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের রিচি'র দ্বীপপুঞ্জ উপবিভাগের অন্তর্গত এবং প্রশাসনিক ভাবে দক্ষিণ আন্দামান জেলার অন্তর্গত। দ্বীপটি পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৩৬ কিমি (২২ মাইল) উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই দ্বীপটি ৩.৭ কিমি লম্বা, ৬.৩ কিমি চওড়া এবং এই দ্বীপটির আয়তন ১৩.৭ বর্গকিমি।দ্বীপটি রিচির দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত এবং হ্যাভলক দ্বীপ এবং রোজ দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত । এটি একটি তুলনামূলক সমতল দ্বীপ, এবং বেশিরভাগ জমি ধান চাষের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল সেকারণে বেশ কিছু বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এর ফলস্বরূপ, বনভূমির পরিমাণ কমে গেছে এবং অবশিষ্ট বনভূমি শহীদ দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম দিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। শহীদ দ্বীপ বনভূমির অভাবের ফলে হ্যাভলকের চেয়ে এক বা দুই ডিগ্রি বেশি উষ্ণ থাকে। এই দ্বীপের সৈকতে ছড়িয়ে অজস্র সাদা প্রবাল। ইতিউতি ছড়ানো নানা রঙের ঝিনুক, ছোট শাঁখ। এসব অবশ্য সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। এই দ্বীপের উপকূলে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ দেখা যায়। এই দ্বীপে রয়েছে চারটি সৈকত ; যথা : রামনগর সৈকত, সীতাপুর সৈকত, ভরতপুর সৈকত ও লক্ষ্মণপুর সৈকত। এই দ্বীপে রয়েছে হাওড়া ব্রিজ নামে পরিচিত একটি প্রাকৃতিক সেতু (Natural Arch)। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এর নামকরণ করা হয় শহীদ দ্বীপ ।
স্বরাজ দ্বীপ (Swaraj Dweep): স্বরাজ দ্বীপের পূর্বনাম ছিল হ্যাভলক দ্বীপ, যা ব্রিটিশ জেনারেল স্যার হেনরি হ্যাভলকের নামে নামকরণ করা হয়েছিল৷ এই দ্বীপটি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের রিচি'র দ্বীপপুঞ্জ উপবিভাগের অন্তর্গত এটি পিল দ্বীপ এবং নিল দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত।এবং প্রশাসনিক ভাবে দক্ষিণ আন্দামান জেলার অন্তর্গত। দ্বীপটি রাজধানী শহর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ৪১ কিমি (২৫ মাইল) উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই দ্বীপটি ১৮ কিমি লম্বা, ৮ কিমি চওড়া এবং এই দ্বীপটির আয়তন ৯২.২ বর্গকিমি। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের একটি হল এই দ্বীপ। বাঙালি অধ্যুষিত গোবিন্দনগর হল এই দ্বীপের সবচেয়ে জমজমাট এলাকা। নারিকেল, তাল, মহুয়ার গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছোটো ছোটো পাহাড়ি টিলা অধ্যুষিত এই দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত সৈকত হল রাধানগর সৈকত। অনেকটা আধফালি চাঁদের আকৃতি নিয়ে বেঁকে গিয়েছে রূপোলি বালির এই সৈকত। সবুজ গাছপালায় ভর্তি পাহাড়ি টিলার পাশ থেকেই যেন পান্না-সবুজ জল ঢুকে এসেছে ভিতরে। এছাড়া আরো চারটি সৈকত, যথা : এলিফ্যান্ট সৈকত, গোবিন্দনগর কালাপাথর সৈকত, বিজয়নগর সৈকত রয়েছে। এলিফ্যান্ট সৈকত প্রবাল প্রাচীরের জন্য বিখ্যাত। এই দ্বীপের উপকূলে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ দেখা যায়। গত ৩০শে ডিসেম্বর 2018 সালে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্বরাজ দ্বীপ হিসাবে এর নামকরণ করেছিলেন।
No comments:
Post a Comment